একজন ঘুড়ি ওড়ানোর মাস্টার ও ছাত্র চণ্ডী

          ঘুড়ি ওড়াতে ওড়াতে লেখাপড়া শেখা।

জমিদারের জমিদারির কথা কে না জানে? ধনসম্পদের অভাব তো নেই! অভাব নেই দাসদাসীরও। কিন্তু জমিদার বাবু ছিলেন নিঃসন্তানের মতো। বিয়ে করার ১২ বছরের মাথায়ও জমিদার বাবু সন্তানের মুখ দেখার সৌভাগ্য তাঁর হয়ে ওঠেনি। 

মহান সৃষ্টিকর্তার কাছে অনেক কান্নাকাটির পর দয়াময়ের কৃপায় এক পুত্রসন্তানের পিতা হলেন, জমিদার বাবু। ছেলের নাম রাখলেন, এক দেবতার নামের সাথে মিল রেখে ‘চণ্ডী’। দিন যায়, মাস যায়, বছর গড়ায়। এভাবে পুত্র চণ্ডী একসময় ৫ বছরের এক বালক হয়ে গেলো।

এখন চণ্ডীর লেখাপড়া শেখার বয়স হয়েছে। এই বয়সে ছেলেপেলেরা মাদ্রাসায় যায়, মক্তবে যায়, স্কুলে যায়। কিন্তু জমিদার পুত্র চণ্ডী এসবের ধারেকাছেও যায় না। চণ্ডী শুধু ঘুড়ি আর ঘুড়ি। ঘুড়ি ছাড়া চণ্ডীর আর কিছুই ভালো লাগে না। সারাদিন তো আছেই, রাতে শোবার সময়ও চণ্ডী তার ঘুড়ি আর নাটাই সাথে নিয়েই ঘুমায়।

ঘুড়ির প্রতি চণ্ডীর এরকম ভাব দেখে জমিদার বাবু দুশ্চিন্তায় পড়ে গেল! দাস-দাসী দিয়ে চণ্ডীকে অনেকবার স্কুলে পাঠিয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। স্কুলে বই খাতা রেখে চণ্ডী বাড়িতে চলে আসে। 

বাড়িতে এসেই ঘুড়ি আর নাটাই নিয়ে চলে যায় মাঠে। চণ্ডীর এরকম অবস্থা দেখে জমিদার বাবু পড়ে গেল মহা চিন্তায়। একটি মাত্র সন্তান! বিশাল সহায়সম্পত্তি! ছেলে যদি লেখা-পড়াই না করে, তাহলে তার এই সহায়সম্পত্তি দেখভাল করবে কে? বংশের নাম রাখবে কে? জমিদার বাবুর এখন দিনে রাতে চোখে ঘুম নেই, খাওয়া নেই! চিন্তা আর চিন্তা! 

একদিন এক বৃদ্ধ মাস্টারের কাছে গিয়ে জমিদার বাবু বিস্তারিত খুলে বললেন। জমিদার বাবুর কথা শুনে বৃদ্ধ মাস্টার হেসে বলল, “এতে চিন্তার কোনও কারণ নেই, জমিদার বাবু। আপনার ছেলে ঘুড়িও উড়াবে, আবার লেখাপড়াও শিখবে।”

মাস্টারের কথা শুনে জমিদার বাবু খুশিতে আত্মহারা! মাস্টারের হাতে ধরে জমিদার বাবু বলল, “মাস্টার বাবু আপনার সদিচ্ছাই হতে পারে আমার ছেলের লেখাপড়া। এখন আপনিই বলুন, আমাকে কী করতে হবে?”

মাস্টার বাবু জমিদার বাবুকে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনার ছেলে কোন রঙের ঘুড়ি উড়াতে বেশি পছন্দ করে? আর ঘুড়ি উড়ানোর নাটাই-ই-বা তার কেমন দরকার হয়?” 

মাস্টার বাবুর কথা শুনে জমিদার বাবু ঘুড়ি বিষয়ে সবকিছু খুলে বললেন। জমিদার বাবুর কথা শুনে মাস্টার বাবু বললেন, “আপনি বাড়ি গিয়ে আপনার ছেলেকে বলবেন, তোমার জন্য ঘুড়ি ওড়ানোর মাস্টার ঠিক করেছি। তুমি যখন ঘুড়িই ওড়াবে, তখন তোমাকে ঘুড়ি বিষয়ে সবকিছু আগে শিখতে হবে। ঘুড়ি বিষয়ে সবকিছু শেখার পর তুমি হবে একজন সফল ঘুড়ি ওড়ানো প্লেয়ার। তাতে তোমারও দাম বাড়বে, আমারও সুনাম হবে। এই কথা শুনেই আপনার ছেলে আনন্দে দিশেহারা হয়ে ওসব। তখন আপনি বলবেন, আগামীকালই তোমার ঘুড়ি উড়ানো মাস্টার বাড়িতে আসছে।”

মাস্টার বাবুর কথা জমিদার বাবু খুব মনোযোগ সহকারে শুনলেন, খুশিও হলেন। তখন মাস্টার বাবু বললেন, “আপনি আমাকে ১০টাকা দিন। এই টাকা দিয়ে ঘুড়ি কিনে আগামীকাল আপনাদের বাড়ি যাবো। ঘুড়ি উড়িয়ে আপনার ছেলেকে লেখাপড়া শেখানো শুরু হবে। বিনিময়ে আমাকে কিছুই দিতে হবে না। কারণ, আমি একজন শিক্ষক। শিক্ষা দান করাই আমার ধর্ম, কর্ম ও পেশা।” 

মাস্টার বাবুর কথামত জমিদার বাবু তার পকেট থেকে ১০টাকা বের করে দিয়ে নিজের বাড়ি চলে এলো।

বাড়ি এসে পুত্র চণ্ডীকে ডেকে আদর করে কাছে বসালো। তারপর পুত্র চণ্ডীকে জিজ্ঞেস করলো, “বাবা তুমি কি লেখাপড়া করবে না? যদি লেখাপড়া না-ই-বা করো, তাহলে আমার এতো ধনসম্পত্তি ভোগদখল করবে কে? তুমি ছাড়া তো আমাদের আর কেহ নেই যে, অন্য কেহ এই জমিদারি ধরে রাখবে! এখন তুমিই বলো কী করবে?”

বাবার কথা শুনে পুত্র চণ্ডী সোজা কথা বলে দিল, “আমি লেখাপড়া করবো না। তোমার এতো ধনসম্পদ থাকতে আমি কষ্ট করে লেখাপড়া করতে যাবো কেন? আমি ঘুড়ি উড়িয়ে সময় কাটাতে চাই। প্লিজ বাবা, আমাকে আর লেখাপড়ার কথা বলবে না।”

পুত্র চণ্ডীর কথা শুনে জমিদার বাবু রীতিমত হতবাক!  ছেলের কথায় দুঃখ পেলেন, জমিদার বাবু। তবু দুঃখ প্রকাশ না করে ছেলেকে আবার আদর করে কাছে বসালেন। এবার ছেলেকে জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি কি ঘুড়ি ওড়ানো শিখেছ?”

বাবার কথায় পুত্র চণ্ডীর জবাব, “এখনো পুরোপুরিভাবে ওড়াতে পারি না বাবা। তো আর কিছুদিনের মধ্যে নাটাই ঘুরানি পুরোপুরি শিখে যাবো।”

জমিদার বাবু ছেলেকে বুকে টেনে নিয়ে আদর করে বলল, “বাবা চণ্ডী, ঘুড়ি ওড়াতে হলে আগে ঘুড়ি ওড়ানো শিক্ষকের কাছ থেকে শিখতে হয়! তা কি তুমি জানো?”

এ কথা শুনে জমিদার পুত্র চণ্ডী এবার জমিদার বাবুকে ঝাপটে ধরে বলল, “বাবা আমার জন্য একজন ঘুড়ি ওড়ানো মাস্টার ঠিক করে দাও! আমি মাস্টারের কাছ থেকে ঘুড়ি ওড়ানো শিখে পাড়ার সকল ছেলেদের ওড়ানো  ঘুড়ি কেচাং কেচাং করে কেটে দিব। প্লিজ! বাবা, একজন ঘুড়ি ওড়ানো মাস্টার আমার চা-ই চাই!”
 
আদরের পুত্র চণ্ডীর আবদারে বাবা জমিদার বাবু বলল, “ঠিক আছে বাবা। তুমি আমার একমাত্র আদরের ছেলে। তোমার আবদার কি আমি না রেখে পারি? আগামীকালই ঘুড়ি ওড়ানো মাস্টার আমার বাড়ি আসবে। তুমি মাস্টারের কাছ থেকে ঘুড়ি ওড়ানো শিখবে। আমিও চাই তুমি একদিন এই ঘুড়ি উড়িয়ে বিশ্ব জয় করবে।”

বাবা জমিদার বাবুর কথা শুনে পুত্র চণ্ডী খুশিতে আত্মহারা! জমিদার বাবুকে জরিয়ে ধরে বলল, “বাবা আমি আপনার কথা চিরদিন স্মরণে রাখবো। আমি এমনভাবে ঘুড়ি ওড়ানো শিখবো, আমার ঘুড়ি আর কেউ কাটতে পারবে না। আমিই সবার ঘুড়ি কেটে দিবো। তুমি আমার জন্য আশীর্বাদ করবে বাবা।” 
এই বলেই আদুরে পুত্র চণ্ডী খুশিতে টগবগিয়ে বাবা জমিদারের কাছ থেকে এক দৌড়ে চলে গেলো। 

পরদিন সকালবেলা জমিদার পুত্র বাড়ির সবার আগেই ঘুম থেকে উঠেই ঘুড়ি ওড়ানো মাস্টারের জন্য অপেক্ষা করছে। যেই পথ দিয়ে জমিদার বাড়িতে প্রবেশ করবে, সেই পথের দিকেই জমিদার পুত্র চণ্ডী তাকিয়ে আছে। 

অপেক্ষা শুধু মাস্টারের জন্য। কখন যে ঘুড়ি ওড়ানোর মাস্টার আসবে, সেদিকেই জমিদার পুত্র চণ্ডীর নজর। 

একসময় জমিদার পুত্র বাড়ির প্রবেশ পথ ধরে আসতে থাকা এক লোককে দেখতে পেলো। বুড়ো বয়সের এক লোক কতগুলো ঘুড়ি হাতে নিয়ে বাড়ির দিকে আসছে। 

জমিদার পুত্র দৌড়ে গিয়ে আগত লোকটির পা ছুঁয়ে নমস্কার করে বলল, “নিশ্চয়ই আপনি আমার ঘুড়ি ওড়ানো মাস্টার?”
মাস্টার বাবু নেড়ে সায় দিয়ে বলল, “তাহলে তুমিই আমার ঘুড়ি ছাত্র চণ্ডী?”

জমিদার পুত্র বলল, "হ্যাঁ, স্যার! আমিই আপনার ছাত্র চণ্ডী! আমাকে আপনি ভালো করে ঘুড়ি ওড়ানো শেখাবেন। যাতে কেউ আমার ঘুড়ি কাটতে না পারে। আমিই সবার ঘুড়ি কেটে দিবো।”

মাস্টার বললেন, “তুমি অবশ্যই পারবে। তবে ঘুড়ি ওড়ানো  শিখতে হতে কিছু নিয়মকানুন আগে শিখতে হয়। তা তোমাকেও শিখতে হবে।”

জমিদার পুত্র চণ্ডী বলল, "স্যার, আপনার দেওয়া সমস্ত নিয়মকানুন শিখেই, আমি ঘুড়ি ওড়ানো শিখবো।”

মাস্টার বলল, ”ঠিক আছে চণ্ডী! তাহলে আগে তোমাকে ঘুড়ির নাম শিখতে হবে।”

মাস্টার বাবুর কথা শুনে জমিদার পুত্র চণ্ডী অবাক হয়ে বলল, “বলেন কি স্যার! ঘুড়ির আবার নাম আছে নাকি?” 

মাস্টার বাবু হেসে বলল, “ভেজাল তো এখানেই চণ্ডী! ঘুড়ির যদি নাম না-ই থাকতো, তাহলে কাগজ আর বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তৈরি চারকোণা একটা বস্তুর নাম ঘুড়ি হলো কীভাবে?”

মাস্টারের কথা শুনে জমিদার পুত্র মাথানত করে বলল, “তাহলে আগে ঘুড়ির নামগুলো আমাকে শিখতে হবে স্যার? তো ঘুড়ির নামগুলো বলুন, আমি শিখে নিই!”

চণ্ডীর কথায় মাস্টার হেসে বলল, “ঘুড়ির অনেক নাম। সবগুলো নাম শিখতে তোমার কয়েকমাস সময় লাগবে। তা কি তুমি ধৈর্য ধরে শিখতে পারবে?”

জমিদার পুত্র চণ্ডী বলল, “তা যতদিনই সময় লাগে লাগুক! আমাকে ঘুড়ির নামগুলো শিখতেই হবে, স্যার। তো বলুন না, ঘুড়ির কতগুলো নাম আছে?”

মাস্টার বলল, “প্রথম স্তরে ১১টি নাম আছে! এই ১১টি ঘুড়ির নাম তুমি মুখস্থ করতে পারলে, এরপর আছে আরও ৩৯ টি নাম। তা কি তুমি পারবে চণ্ডী?”

জমিদার পুত্র চণ্ডী হেসে বলল, “এটা আমার জন্য কোনও ব্যাপারই না, স্যার। আমি ফটাফট শিখে ফেলবো।”

মাস্টার বলল, “বেশ! তাহলে তুমিই হবে ঘুড়ি ওড়ানোর  সেরা খেলোয়াড়। তাহলে শুরু করা যাক, আগে ১১টি ঘুড়ির নামগুলো শেখা!”

মাস্টার বাবু জমিদার বাড়ি আসার আগেই ১১টি ঘুড়ির গায়ে ১১টি স্বরবর্ণ লিখে এনেছিলেন। যথাক্রমে– অ আ ই ঈ উ ঊ ঋ এ ঐ ও ঔ। 

মাস্টার বাবু সাথে আনা ঘুড়িগুলো জমিদার পুত্র চণ্ডীর সামনে মাটিতে বিছিয়ে দিয়ে বলল, “এখন দেখ, ঘুড়ির গায়ে লেখা আছে ঘুড়ির নাম। এই নামগুলো তুমি পড়বে, আবার ঘুড়ির গায়ে লেখা দেখে দেখে মাটিতে লিখবে। মুখস্থ হয়ে গেলে বাড়িতে গিয়ে কাগজের খাতায় তা লিখে রাখবে। তাহলে আর কোনদিন এই শেখা নামগুলো তুমি ভুলে যাবে না।”

জমিদার পুত্র বলল, “আমার লেখাপড়ার জন্য বাবা কাগজের অনেকগুলো খাতা কিনে রেখেছে। কিন্তু আমি ওইসব খাতায় কোনদিন লিখিনি। আপনি যখন বলছেন, তো ঘুড়ির নামগুলো আমি বাড়ি গিয়ে একটা একটা করে লিখে রাখবো, স্যার। এখন একটা ঘুড়ি নাটাইতে বেঁধে দিন, আমি ওড়াতে থাকি।”

মাস্টার বাবু বলল, “তা তো তুমি ওড়াবেই। কিন্তু আজকে এই ১১টি ঘুড়ির নাম মুখস্থ করতে হবে। মুখস্থ হয়ে গেলে আগামীকাল থেকে তোমার ঘুড়ি আকাশে ওড়াবে।” 

মাস্টার বাবুর কথা শুনে জমিদার পুত্র বলল, “ঠিক আছে স্যার, তাহলে আপনি একটা একটা করে নামগুলো বলে দিন; আমিও মুখস্থ করতে থাকি!”

মাস্টার বাবু বলতে লাগলো, “এটা ‘অ’, এটা ‘আ', এটা ‘ই', এটা ‘ঈ', এভাবে উ, ঊ, ঋ, এ, ঐ, ও, ঔ, মোট ১১টি।”

জমিদার পুত্র মাটিতে বসে ১১টি ঘুড়ি সামনে নিয়ে মনের আনন্দে ‘অ' ‘আ’ ‘ই’ ‘ঈ’ পড়তে শুরু করলো। একবার পড়ে, আবার একটা কাঠি দিয়ে মাটিতে লেখে।

এভাবে সকাল থেকে দুপুর হয়ে গেল, কিন্তু জমিদার পুত্র চণ্ডীর পড়া শেষ হচ্ছে না। মাস্টার বাবুও জমিদার পুত্র চণ্ডীর সাথেই সময় কাটিয়ে দিচ্ছে। 

এদিকে জমিদার বাবু সকাল থেকে আদরের ছেলেকে না দেখে এদিক-ওদিক খুঁজা-খুঁজি করছে। কিন্তু বাড়ির ভেতরে কোথাও চণ্ডীকে পাওয়া গেল না। বাড়ির ভেতরে ছেলেকে না পেয়ে জমিদার বাবু বুঝতে পারলো, ছেলে ঘুড়ি নিয়েই হয়ত ব্যস্ত সময় পার করছে। 

এই ভেবে জমিদার বাবু বাড়ির বাইরে যেতেই, চোখ পড়ল মাঠের দিকে। দেখে মাস্টার বাবুর সাথে আদরের ছেলে চণ্ডী বসে আছে। জমিদার বাবু সামনে গিয়ে মাস্টার বাবুকে প্রণাম জানিয়ে বললেন, “আপনি কখন এসেছেন মাস্টার বাবু?”

মাস্টার বাবু বললেন, “আমি তো সেই সকালবেলাই আপনার বাড়ি এসেছি। আসার পথেই আপনার আদরের পুত্র চণ্ডীকে পেয়ে গেলাম। ব্যস, শুরু করে দিলাম আমাদের ঘুড়ির খেলা। তা এখনো চলছে, জমিদার বাবু।”

জমিদার বাবু দেখতে পাচ্ছে, তার আদরের ছেলে বসে বসে ঘুড়ি দেখে দেখে মাটিতে লিখছে। এই অবস্থা দেখে জমিদার বাবুর বিশ্বাস হলো এখন থেকে তার ছেলের লেখাপড়া শুরু! 

জমিদার বাবু খুশি হয়ে মাস্টার বাবুকে বললেন, “চলুন, বাড়িতে গিয়ে আমরা কিছু জলখাবার করে নিই!”

মাস্টার বলল, “তা আর এখন দরকার নেই, জমিদার বাবু। আপনি আপনার ছেলেকে আজকের মত বাড়িতে নিয়ে চলে যান। বিকালবেলা ওকে একটা খাতা কলম হাতে ধরিয়ে দিবেন। কলম দিয়ে আপনার ছেলে চণ্ডী এই ১১টি ঘুড়ির নাম লিখে রাখবে। আগামীকাল আমি আসলে, তার লেখাগুলো আমি দেখবো।”

এভাবে জমিদার পুত্র চণ্ডীকেও বুঝিয়ে দিয়ে মাস্টার নিজের বাড়ি চলে গেল। জমিদার বাবু তার আদরের ছেলে আর ঘুড়িগুলো সাথে নিয়ে বাড়ি চলে গেলো।

বাড়ি গিয়ে চণ্ডী তাড়াতাড়ি স্নান করে কোনরকম সামান্য কিছু খেয়ে খাতা কলম আর ঘুড়ি নিয়ে নিজ ঘরের খাটের পর বসে পড়লে। চণ্ডীর মুখে এখন শুধু ‘অ' ‘আ' ‘ই' ‘ঈ' ‘উ’ ‘ঊ' ‘ঋ' ‘এ' ‘ঐ' ‘ও' ‘ঔ' এভাবে ১১টি ঘুড়ির নাম। রাতেও ঘুমের ঘোরে চণ্ডী অ, আ, ই, ঈ, বলছে তো বলছেই।

পরদিন আবার মাস্টার বাবু যথাসময়ে জমিদার বাড়ি এসে উপস্থিত হলেন। ১১টি ঘুড়ি আর জমিদার পুত্র চণ্ডীকে নিয়ে মাঠে গেলেন। আজকে সাথে আছে খাতা আর কলমও। 

মাস্টার বাবু মাঠে গিয়ে চণ্ডী থেকে মুখস্থ করা পড়া নিলেন। লেখা দেখলেন। চণ্ডীর প্রশংসা করলেন। চণ্ডীকে বললেন, “প্রথম ঘুড়ি কোনটা এবং নাম কী?”

চণ্ডী বললো, প্রথম ঘুড়ির নাম হলো ‘অ' স্যার।

মাস্টার বাবু আদেশ দিলেন ১১টি ঘুড়ি থেকে এই ‘অ' ঘুড়িটা বের করে নাটাইয়ের সূতোর সাথে বেঁধে ওড়াতে থাকো। ‘অ’ ঘুড়ি কাটা পড়লে, এর পরেরটা ‘আ' ঘুড়িটা বেঁধে ওড়াবে। এভাবে এই ১১টি ঘুড়ি ওড়ানোর পর আমি বাদবাকি ৩৯টি ঘুড়ি একসাথে কিনে নিয়ে আসবো। এই ১১টি ঘুড়ির নাম তুমি যেভাবে শিখেছ, ঠিক ৩৯টি ঘুড়ির নামও একইভাবে তোমাকে শিখতে হবে। 

“প্রথম প্রথম ঘুড়ি কাটা পড়লে দুঃখ করবে না। কাটা খেতে খেতেই একদিব তুমি অপরের ঘুড়ি কেটে দিতে পারবো। আগে তোমার ঘুড়ি কাটা না পড়লে, পরের ঘুড়ি তুমি কাটতে পারবে না।”

এই বলে মাস্টার বাবু চণ্ডীকে মাঠে রেখে নিজ বাড়িতে চলে গেল।


চণ্ডী সারা দুপুর ‘অ' ঘুড়িটি উড়িয়েছে। কারোর ঘুড়ির সাথে আর কাটা পড়েনি। পেটে ক্ষুধা অনুভব হলে, চণ্ডী ঘুড়িগুলো আর নাটাই হাতে নিয়ে বাড়ি চলে গেলো।

চণ্ডী বাড়িতে যাবার পর জমিদার বাবু আদরের ছেলেকে ডেকে বলে, “বাবা চণ্ডী, তোমার মাস্টার বাবু কোথায়?”

চণ্ডী বলল, “উনি আমাকে সব দিকনির্দেশনা দিয়ে বাড়ি চলে গেছে। এই ১১টি ঘুড়ি শেষ হলে আবার তিনি আমার জন্য ৩৯টি ঘুড়ি নিয়ে আসবে।”

বাবা জমিদার বাবু বুঝতে পেরেছে যে ঘটনা কী ঘটতে যাচ্ছে।

চণ্ডী তাড়াতাড়ি করে স্নান করে খাওয়া-দাওয়া করতে করতে দিনের সময় প্রায় শেষ পর্যায় এসে পড়েছে। চণ্ডী ভাবলো, “এখন আর ঘুড়ি নাটাই নিয়ে মাঠে যাওয়া ঠিক হবে না। তার চেয়ে বরং খাতা কলম নিয়ে ঘুড়ির নামগুলো খাতায় লিখতে থাকি।" 

এই ভেবেই চণ্ডী খাতা কলম আর ঘুড়িগুলো নিয়ে নিজের ঘরের খাটের পর গিয়ে বসে পড়লো। এভাবে ১১টি ঘুড়ি শেষ করতে জমিদার পুত্রের প্রায় ১৫ দিন কেটে গেল।

যথাসময়ে মাস্টার বাবু আবার ৩৯টি ঘুড়ি নিয়ে জমিদার বাড়িতে উপস্থিত হলো। এবার ৩৯ ব্যঞ্জনবর্ণ ‘ক' ‘খ' ‘গ’ ‘ঘ’ ‘ঙ' ‘চ' ‘ছ' ইত্যাদি লেখাযুক্ত ঘুড়ির পালা হবে শুরু। 

জমিদার পুত্র চণ্ডীকে যেভাবে ১১টি স্বরবর্ণ লেখাযুক্ত ঘুড়ি উড়িয়ে ‘অ' ‘আ' ‘ই' ‘ঈ' শিখিয়েছে, ঠিক একইভাবে ৩৯টি ব্যঞ্জনবর্ণ লেখাযুক্ত ঘুড়ি দিয়ে তাও শিখিয়েছে। 

এভাবে দিন যেতে লাগলো, মাস যেতে লাগলো। চণ্ডীও আস্তে আস্তে ঘুড়ির চেয়ে লেখাপড়ার দিকেই বেশি ঝুকে পড়ছে। চণ্ডীর এখন আর ঘুড়ির প্রতি তেমন নেশা নেই। নেশা শুধু পড়া আর লেখার দিকে। 

এভাবে একদিন জমিদার পুত্র চণ্ডী নিকটস্থ স্কুলে ভর্তি হলো। ওয়ান থেকে শুরু করে মেট্রিক পাস করলো। যেদিন মেট্রিক পরীক্ষার রেজাল্ট বের হলো, জমিদার পুত্র ফার্স্ট ডিভিশন নিয়ে পাস করলো।

রেজাল্ট হাতে নিয়ে চণ্ডী তার বাবাকে প্রণাম করতে গেলে, বাবা জমিদার বাবু চণ্ডীকে বলল, “এই খুশির খবর আর ভক্তির প্রণাম আগে আমাকে নয়! এই খবর আর প্রণাম তোমার ঘুড়ি ওড়ানোর শিক্ষক মাস্টার বাবুকে দিতে হবে।যার দয়ায় আর পরিশ্রমের বিনিময়ে আজ তুমি শিক্ষিত।

যাও তাড়াতাড়ি গিয়ে তোমার ঘুড়ি ওড়ানোর শিক্ষার মাস্টার বাবুকে প্রণাম করে তার আশীর্বাদ নিয়ে আসো। তারপর আমাদের প্রণাম করবে। 

চণ্ডী এখন শিক্ষিত ছেলে। তাই বাবার আদেশ অমান্য না করে চণ্ডী সোজা চলে গেল তার ছোটবেলার ঘুড়ি ওড়ানোর শিক্ষক মাস্টার বাবুর বাড়িতে। 

মাস্টার বাবুকে প্রণাম করে আশীর্বাদ নিয়ে চলে এলো নিজের বাড়িতে। বাড়িতে এসে বাবা জমিদারের বাবুকে আর মাকে প্রণাম করলো,মা-বাবার আশীর্বাদ নিলো এরপর আরও লেখাপড়া শিখে চণ্ডী একদিন নিজেই এক কলেজের অধ্যাপক হয়ে গেলো।

এভাবে ঘুড়ি ওড়ানো শিক্ষকের মতন শিক্ষায় আর চণ্ডীর মতো চেষ্টায় শুধু জমিদার পুত্র চণ্ডীই নয়, অনেক অজ্ঞানী  মানুষও অনেকদূর এগিয়ে যেতে পারে।
এখানে সমাপ্ত।।

প্রিয় পাঠক, লেখা পড়ে ভালো লাগলে দয়াপূর্বক লাইক/কমেন্ট ও শেয়ার করে বাধিত করবেন। 

ব্লগ ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম,
২৮/০৫/২০২৩ইং।

মন্তব্যসমূহ

  1. সুন্দর গুরুত্বপূর্ণ একটা লেখা পড়লাম। লেখককে ধন্যবাদ!

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

nitaibabunitaibabu@gmail.com

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আমার শৈশবের বন্ধু— শীতলক্ষ্যা

একটি মাঠ; হাজারো প্রাণের স্মৃতি

মা নাই যার, সংসার অরণ্য তার