দূর হোক শিবলিঙ্গ নিয়ে ভুল ধারণা – একটি তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণ

 

🔱 দূর হোক শিবলিঙ্গ নিয়ে ভুল ধারণা

আমরা সনাতন ধর্মে বিশ্বাসী, তাই বর্তমানে এই উপমহাদেশে আমরা ‘হিন্দু’ নামে পরিচিত। এ কারণে অনেকসময় আমাদের মুসলমান বন্ধুরা কিংবা আশেপাশের মানুষ নানা প্রশ্ন করে থাকেন। কেউ বলে ফেলেন — চাড়াল, মালাউন, ডেডাইয়া, বিধর্মী ইত্যাদি। আবার কেউ প্রশ্ন করে —

  • সনাতন ধর্মের মানুষ মৃত্যুর পর পোড়ানো হয় কেন?
  • বারো মাসে তেরো পূজা বলতে কী বোঝায়?
  • ৩৩ কোটি দেবতার নাম জানা আছে?
  • লিঙ্গ পূজা করা হয় কেন?
  • মাটির মূর্তি বানিয়ে এত টাকা খরচ করে পূজা করে, আবার ফেলে দেওয়া হয় কেন?

এসব প্রশ্নের পেছনে একটা বড় কারণ হল ভুল ধারণা আর সঠিক তথ্যের অভাব। অনেকেই মনে করেন, হিন্দু ধর্ম মানেই মূর্তিপূজা ও হরিনাম সংকীর্তন — যা একটি একরৈখিক ভুল ধারণা।

📜 ‘হিন্দু’ শব্দের উৎপত্তি ও বৈদিক ব্যাখ্যা

‘হিন্দু’ শব্দটি বৈদিক শাস্ত্রে নেই, এটি ঊনবিংশ শতাব্দীতে গঠিত একটি রাজনৈতিক ও সামাজিক শ্রেণি নির্দেশক শব্দ। মূলত ‘সিন্ধু’ নদীর পাশ্ববর্তী বাসিন্দাদের পারস্যবাসীরা উচ্চারণ করত ‘হিন্দু’। এ থেকেই নামকরণ।

তবে ‘হিন্দু’ শব্দটি ‘হিংসা করেন না’হিংসা আর অহংকারে

সনাতন ধর্মের মূলতত্ত্ব ভুলে গেছি। সাধারণ মানুষ ধর্ম জানার আগ্রহ প্রকাশ করলেও পুরোহিত, গুরু বা পণ্ডিতেরা বলেন, “এখনও তোমার বোঝার সময় হয়নি, কেবল গুরুর নাম জপ করো।”

📚 সনাতন ধর্মের মূল গ্রন্থসমূহ

যে গ্রন্থগুলি সনাতন ধর্মের মূল ভিত্তি —

  1. বেদ (৪টি): ঋগ্বেদ, যজুর্বেদ, সামবেদ, অথর্ববেদ
  2. উপনিষদ (১০৮টি)
  3. ভগবদ গীতা (৭০০ শ্লোক)
  4. ভাগবত (১৮,০০০ শ্লোক)
  5. মহাভারত (৬০,০০০ শ্লোক)
  6. পুরাণ (১৮টি)
  7. রামায়ণ
  8. চৈতন্য চরিতামৃত

🙏 ৩৩ কোটি না, ৩৩ রকম দেবতা

সংস্কৃত ‘কোটি’ শব্দের দুইটি অর্থ রয়েছে — একটি হচ্ছে সংখ্যাগত ‘কোটি’ এবং অপরটি হচ্ছে ‘সর্বোচ্চ’। ঋগ্বেদে শুরুতে ৩ রকমের দেবতার উল্লেখ পাওয়া যায়: অগ্নি, বায়ু ও সূর্য। পরবর্তীতে দেবতার সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৩৩ হয়। এদের মধ্যে:

  • ১১ জন পৃথিবীতে
  • ১১ জন বায়ুতে
  • ১১ জন অন্তরিক্ষে অবস্থান করেন

🌙 শিবরাত্রি ও শিবলিঙ্গ পূজা

শিবরাত্রি ফাল্গুন মাসের কৃষ্ণপক্ষের চতুর্দশীতে উদযাপিত হয়। এই ব্রতের দিন ভক্তগণ উপবাস পালন করেন, রাতে চার প্রহরে দুধ, দই, ঘৃত, মধু ও গঙ্গাজল দিয়ে শিবলিঙ্গ স্নান করানো হয়। বেলপাতা, ধুতুরা, আকন্দ, অপরাজিতা ফুল দিয়ে পূজা হয় এবং “ওঁ নমঃ শিবায়” মন্ত্র জপ করা হয়।

🕉️ শিবলিঙ্গ – একটি প্রতীক

শিব মানে সত্য, সুন্দর ও মঙ্গল এবং ‘লিঙ্গ’ মানে ‘প্রতীক’। এটি কোনও অশ্লীলতার প্রতীক নয়। শিবলিঙ্গে ৩টি অংশ রয়েছে:

  1. নিচের চারমুখী অংশ – ব্রহ্মার প্রতীক
  2. মাঝের আটমুখী অংশ – বিষ্ণুর প্রতীক
  3. উপরের অর্ধবৃত্ত অংশ – শিবের প্রতীক

গৌরীপট্ট নামে যে অংশ থেকে জল বের হয়, সেটিও প্রতীকী। কারণ, সকল মানুষ এই পথেই পৃথিবীতে এসেছে। শিবলিঙ্গ ব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি-প্রক্রিয়ার প্রতীক — যা সত্য, সৃজনশীলতা ও ধ্বংসের প্রতিফলন।

👧 শিব পূজায় নারীদের ভূমিকা

একসময় মনে করা হতো, অবিবাহিত মেয়েরাই কেবল শিব পূজা করতে পারে। আবার কেউ কেউ বলে, মেয়েদের শরীর সবসময় পবিত্র নয় — এ ধরণের ভুল ধারণা এখনো আছে। অথচ বাস্তবে বহু বিবাহিত ও অবিবাহিত মেয়েই শিবরাত্রিতে উপবাস থেকে শিবলিঙ্গ পূজা করে থাকেন।

শিব পুরাণেও নারীদের শিবভক্তির বহু প্রমাণ আছে। বিবাহিত নারীরা স্বামীর আয়ু ও মঙ্গল কামনায়, আর অবিবাহিত নারীরা আদর্শবান স্বামীর কামনায় শিব ব্রত পালন করেন। শুদ্ধ পঞ্জিকা অনুযায়ী প্রতিবছর শিবরাত্রি ও শিবলিঙ্গ পূজা সম্পন্ন হয়।

📲 পরিশেষে

তথ্যপ্রযুক্তির যুগে ইন্টারনেট ও গুগল আমাদের সামনে বিশাল তথ্যভাণ্ডার খুলে দিয়েছে। অথচ আমরা নিজেরা সঠিক তথ্য যাচাই না করে বিভ্রান্তি ছড়াই। কিছু মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে শিবলিঙ্গ পূজার অপব্যাখ্যা দিয়ে মানুষের মধ্যে ভ্রান্তি ও ধর্মীয় বিদ্বেষ তৈরি করে।

এমন ভুল ধারণা দূর করতে হলে তথ্য জানতে হবে, বুঝতে হবে, পড়তে হবে। সবাই যেন বোঝে — যেখানে সত্য, সেখানেই শিব। যেখানে শিব, সেখানেই সুন্দর। যেখানে সত্যের প্রতীক, সেখানেই শিবলিঙ্গ।

🕊️ সত্যম্ শিবম্ সুন্দরম্

🔖 তথ্যসূত্র: শিব পুরাণ, ঋগ্বেদ, ভাগবত, গীতা ও অন্যান্য অনলাইন ধর্মীয় গ্রন্থ এবং হিন্দু ধর্মবিষয়ক ওয়েবসাইট।


✍️ লিখেছেন: নিতাই বাবু
🏆 পুরস্কারপ্রাপ্ত নাগরিক সাংবাদিক – ২০১৭
📘 ব্লগ: জীবনের ঘটনা | নিতাই বাবুর ব্লগ | চ্যাটজিপিটি ভাবনা
🤝 সহযোগিতায়: ChatGPT by OpenAI

👉 শেয়ার করুন:

Facebook Twitter WhatsApp Email

📢 এই পোস্টটি শেয়ার করুন:

Facebook Twitter WhatsApp Email

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আমার শৈশবের বন্ধু— শীতলক্ষ্যা

একটি মাঠ; হাজারো প্রাণের স্মৃতি

মা নাই যার, সংসার অরণ্য তার