পোস্টগুলি

মা নাই যার, সংসার অরণ্য তার

ছবি
মা নাই যার সংসার অরণ্য তার — নোয়াখালীর মাহাতাবপুরের মায়ের স্মরণে মা ছিল আমার, এক মাটির প্রতিমা, নোয়াখালীর মাহাতাবপুর, বজরার কাছে ছিল তার ভূমিকা। চৌমুহনী থানার প্রান্তে, শান্ত এক হিন্দু পরিবারে, ছয় সন্তানের জননী হয়ে, আলো জ্বেলেছিলেন ঘরে ঘরে। তার কপালের সিঁদুর যেন ছিল সূর্যোদয়ের প্রতিচ্ছবি, তার আঁচলে ছিল গন্ধ, ধানভাঙা বিকেলের ছবি। তিনি ছিলেন ঘরের শ্রুতি, প্রতিটি শিশুর মুখে হাসি, জীবনের কষ্টকে ঢেকে রাখতেন মায়াবী ভালবাসায় ভাসি। ভোরে উঠেই হাঁড়িতে চড়াতেন ভাত, শীতের সকালে কাঁপতে কাঁপতে দিতেন গায়ে হাত। ঈশান কোণে প্রদীপ জ্বলত, তারই প্রার্থনায়, আমার ছোট ছোট দুঃখগুলো গলে যেত মায়ের ছায়ায়। আজ তিনি নেই... ঘরের উঠোনে আর তার পায়ের চিহ্ন পড়ে না, ভাতের হাঁড়িতে তার হাতের গন্ধ আর জাগে না। আলো জ্বালানো সেই চোখজোড়া এখন নিভে গেছে, শুধু স্মৃতির ঝর্নাধারায় মন আমার ভেসে চলে, ক্লান্ত, অনিশ্চিত পথ বেয়ে। দরজায় আজো কাঁপে হাওয়া, কিন্তু সে তো মায়ের নয়, দেয়ালে আজো ঝোলে ছবিখানি, নিঃশব্দে কেবল কাঁদে অশ্রু-ঢেউয়ে। তার ডাকা নামে কেউ আর ডাকেন...

বিষ টাকার পথে: বীরপাড়া থেকে ভুটান ফুন্টলসিং

ছবি
বিশ টাকার পথে: বীরপাড়া থেকে ভুটান ফুন্টসলিং ১৯৯৩ সাল। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় একদিন আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গে পা বাড়াই ভারতের পথে। আমাদের যাত্রার সূচনা বেনাপোল বর্ডার পেরিয়ে বনগাঁ শহরে। দিনটি ছিল বিশেষ—বাংলা বছরের প্রথম দিন, পহেলা বৈশাখ, ১৪০০ বঙ্গাব্দ । আমরা ছিলাম চারজন—আমি, আমার বন্ধু, আর তার দুই বোন। বনগাঁ থেকে রাত দশটার ট্রেনে চড়ে দমদমে পৌঁছাই প্রায় রাত বারোটায়। সেখান থেকে সরাসরি বন্ধুর আত্মীয়র বাড়িতে গিয়ে রাত কাটাই। পরদিন খুব ভোরে রওনা হলাম শিয়ালদা হয়ে বন্ধুর বাড়ি। কয়েক সপ্তাহ পর বুঝলাম, সেখানে আমার আশার আলো নেই। সিদ্ধান্ত নিলাম—যেতে হবে উত্তরবঙ্গের বীরপাড়ায়, বড় দিদির বাড়িতে। বীরপাড়া, জলপাইগুড়ি জেলার ছোট্ট একটি শহর। একসময় এই এলাকা ছিল চা-বাগানে ঘেরা। ধীরে ধীরে বাজার, মহল্লা, আর ঘন বসতির গড়ে ওঠা—সবই চা-বাগানের জমিতে। আমার বড় দিদির বাড়ি ছিল রবীন্দ্র নগর কলোনিতে । দিদি আমাকে চিনতে পারেননি প্রথমে। কারণ তার বিয়ের সময় আমার বয়স ছিল মাত্র দেড় বছর। ১৯৬৪ সালে দিদি ও জামাইবাবু ভারতে চলে যান এবং আর কখনো দেশে ফেরেননি। প্রায় ৩০ বছর পর সেই দিদির বাড়ি গিয়ে পরিচয় ...

স্বাধীনতা-পরবর্তী: নোয়াখালী থেকে নারায়ণগঞ্জ

ছবি
   স্বাধীনতা-পরবর্তী: নোয়াখালী থেকে নারায়ণগঞ্জ — এক জীবন্ত দলিল ✍️ নিতাই বাবু) (জন্ম: ৮ জুন ১৯৬৩, মাহাতাবপুর, নোয়াখালী | বর্তমান নিবাস: নারায়ণগঞ্জ) 🌾 মাহাতাবপুর: আমার শৈশবের স্বর্গভূমি আমার জন্ম ১৯৬৩ সালের ৮ই জুন, নোয়াখালীর চৌমুহনী থানার অন্তর্গত বজরা রেলস্টেশনের পাশের গ্রাম মাহাতাবপুরে। আমাদের পরিবার ছিল গ্রামের মধ্যে অন্যতম প্রতিষ্ঠিত ও সম্মানিত হিন্দু পরিবার। আমার শৈশব যেন ছিল এক নির্মল সময়ের রঙিন ক্যানভাস — ট্রেনের হুইসেল, পাশের খালের জেলেদের মাছ ধরা, আম-কাঁঠালের বাগানে খেলাধুলা, আর সন্ধ্যায় হারিকেনের আলোয় গল্পে মেতে ওঠা। 🔥 একাত্তরের আগুনে আমাদের উঠোন ১৯৭১ সালে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। আমার জ্যাঠা ছিলেন পাকিস্তান আমলে পুলিশ বাহিনীতে চাকরি করা একজন দেশপ্রেমিক মানুষ। তাঁর অভিজ্ঞতা ও নেতৃত্বে আমাদের বাড়ি হয়ে ওঠে মুক্তিবাহিনীর এক গোপন ঘাঁটি। প্রতিদিন সন্ধ্যায় মুক্তিযোদ্ধারা এসে জড়ো হতেন, আমার জ্যাঠার সঙ্গে যুদ্ধের পরিকল্পনা করতেন। অস্ত্রও আনা হতো গোপনে। শিশুরা দূরে থাকত, তবু টের পাওয়া যেত সবকিছু। ⚔️ স্বাধীনতা, কিন্তু শান্তি ন...

আমি এদেশে সংখ্যালঘু

ছবি
আমি এদেশে সংখ্যালঘু আমি এদেশে সংখ্যালঘু , তবুও আমি “এদেশের” — এই মাটি, এই জল, এই পল্লীর পেঁপে গাছ, এই বর্ষার জলঢাকা পথ— সবই আমার চেনা। আমি হিন্দু, আমি বৌদ্ধ, আমি খ্রিস্টান— তবু আমি বাংলাদেশী , আমি সেই মা-বাবার সন্তান, যারা একাত্তরে কাঁধে বোমা নয়, কাস্তে-কলম-লাঠি তুলে দাঁড়িয়েছিল পাক-হানাদারের বিপক্ষে। আমার দাদার বুকেও বয়ে গিয়েছিল গুলি, জন্মভূমিকে ভালোবেসে। কিন্তু আজ তার নাতি আমি— নতুন করে পরিচয়ের সনদ চাই। আমি এদেশে সংখ্যালঘু, আমার ঈশ্বরকে আমি মাটির মূর্তিতে দেখি— তাই আমি ভয় পাই, কারণ একদিন সেই মূর্তি ভাঙা হয় ‘অপরাধে’ যে আমি ভিন্ন রূপে ঈশ্বরকে ভালোবাসি। আমি শারদীয়া দুর্গাপূজায় মা দুর্গাকে স্বাগত জানাই, আর সেই সময় আমার কাঁপে বুক— বাজার থেকে ফেরার পথে গলার মালা ছিঁড়ে ফেলা হতে পারে, ঘরের প্রতিমায় পাথর ছোঁড়া হতে পারে। পুলিশ হয়তো আসবে, আবার হয়তো আসবেই না। আমি স্কুলে বাংলায় ‘মা’ লিখি, কিন্তু প্রশ্ন আসে— “তুমি হি...

আমিও এদেশের মানুষ

ছবি
----আমিও এদেশের মানুষ---- একজন সংখ্যালঘুর কণ্ঠস্বর! আমি হিন্দু, তাই আমি এদেশে চারাল আমি অল্পশিক্ষিত, তাই আমি গণ্ডমূর্খ আমি গরীব, তাই আমি এদেশে অবহেলিত আমি পুজো করি, তাই আমি এদেশে ঘৃণিত। আমি দীপ জ্বালালে বলে — অশুভ আগুন আমি ঘণ্টা বাজালে বলে — যন্ত্রণা দেয় কানে আমি নাম না জপে, শুধু শান্তি চাই — তবু বলে, আমি ধর্মদ্রোহী, আমি অমানুষ! আমি কোরবানির বিরোধিতা করি না, তবু আমার উঠানে ছাগল বাঁধা অপরাধ আমি দুর্গাপূজায় আলপনা আঁকি — তবু বলে, এই দেশে আমার সংস্কৃতির অধিকার নাই। আমি "জয় মা" বলি — কেউ হাসে, কেউ হিংসে করে আমি নমস্কার করি — বলে, সালাম শেখ না রে! আমি খুশি থাকলে — গুজব ওঠে, বুঝি ইন্ডিয়ার টাকা আমি দুঃখী হলে — বলে, নাটক করিস! তোদের তো দেশই নাই! তবু আমি বলি — আমিও মানুষ! আমারও রক্ত লাল, আমারও বুক কাঁপে, আমারও মা আছেন, আমারও সন্তান স্বপ্ন দেখে। সময়সময় কৃতজ্ঞ রাখি, সংখ্যালঘু নির্যাতনে প্রতিবাদ দেখি! বহু মানুষ করে প্রতিবাদ অন্যায়ের, মানববন্ধন করে সবাই ন্যায়বিচারের। বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে, শহরের ...

ঘরে বাইরে চলছে ক্রিকেট জুয়া

ছবি
     ক্রিকেটের আড়ালে সর্বনাশা জুয়া বর্তমানে হাতে হাতে স্মার্টফোন! ঘরে ঘরে রঙিন টেলিভিশনের ছড়াছড়ি। সাথে পাচ্ছে সীমিত মূল্যে 4G ইন্টারনেট সেবা এবং ওয়াইফাই। দেশের আনাচে-কানাচে, হাট-বাজারে, অলি-গলির প্রতিটি দোকানে চলছে টিভি চ্যানেলে ক্রিকেট খেলা। এই জনপ্রিয় খেলার ভেতরে চলছে আরেক ভয়াবহ খেলা — মরণঘাতী গুপ্ত জুয়া । ক্রিকেটের মাঠে উইকেট খেলে না, খেলে খেলোয়াড়রা। আর মাঠের বাইরের অনেক ভক্ত এই খেলার নামে খেলছে সর্বনাশা জুয়া। আমার ক্রিকেট স্মৃতি ❝সময়টা ছিল স্বাধীনতা পরবর্তী ১৯৭৪-১৯৭৫ সাল। আমরা তখন টেনিস বল দিয়ে ব্যাটবল খেলতাম। বল না থাকলে ছেঁড়া কাপড় মুড়িয়ে বানাতাম বল। স্টাম্প বানাতাম গাছের ডালা বা ইট সাজিয়ে। ব্যাট হিসেবে থাকত কাঠের তক্তা। বল করতাম গড়িয়ে।❞ খেলোয়াড় বলেই জানতাম সবাইকে। উইকেট বা ব্যাটসম্যান শব্দ তখন অজানা। আজ সেই ব্যাটবল হয়ে গেছে জাতীয় ক্রিকেট খেলা, যা নিঃসন্দেহে জাতির জন্য এক গৌরব। জাতীয় ক্রিকেট ও তার উত্থান: ক্রিকেটের জন্ম ষোড়শ শতকে হলেও প্রথম টেস্ট খেলা শুরু হয় ১৮৭৭ সালে। বাংলাদেশের ক্রিকেট আন্তর্জাতিক অঙ্গনে আত্মপ্রকাশ করে ১৯৭৯ সালে...

আমায় যদি প্রশ্ন করো, কেমন তোমার বাংলাদে?

ছবি
আমায় যদি প্রশ্ন করো, কেমন তোমার বাংলাদেশ? আমায় যদি প্রশ্ন করো, কেমন তোমার বাংলাদেশ? আমি মাথা নিচু করে বলব—এ এক গভীরতর বেদনার বাংলাদেশ। এ দেশে শিশুরা খুন হয়, কন্যারা ধর্ষিত হয়, তরুণেরা গুম হয়ে যায়, বয়োজ্যেষ্ঠরা অপমানিত হন, বিচার চাওয়ার চেয়ে চুপ থাকাই নিরাপদ মনে হয়। রাস্তায় বের হলে ঘরে ফেরা অনিশ্চিত, ট্রেন-বাসে উঠলে জান-বাঁচানোর তাগিদে প্রার্থনা করতে হয়। গলির মোড়ে ছিনতাই, হাটে-বাজারে প্রতারণা, রাজপথে রাজনৈতিক রাহাজানি— এই যেন আমাদের দৈনন্দিন চিত্র। কুমিল্লার রামচন্দ্রপুরে সম্প্রতি ঘটে যাওয়া নির্মম ঘটনা আমাদের অন্তরকে রক্তাক্ত করেছে। শ্বশুরবাড়ি থেকে বাবার বাড়িতে বেড়াতে আসা এক বর্মণ সম্প্রদায়ের ২৫ বছর বয়সী নারী — দরিদ্র এক মৎস্যজীবী পরিবারের সদস্য, যার কোনো প্রভাব-প্রতিপত্তি নেই, শুধুই একজন মানুষ, শুধুই একজন মেয়ে। রাতের আঁধারে তার ঘরে ঢুকে এক পিশাচ তাকে ধর্ষণ করেছে— তার কান্না, তার প্রতিবাদ, তার অসহায়ত্ব ছুঁয়ে যায় না এই সমাজকে। সমাজ তখনও নীরব থাকে, প্রশাসন তখনও উদাস, কিছু মিডিয়া কাভা...