বিষ টাকার পথে: বীরপাড়া থেকে ভুটান ফুন্টলসিং


বিশ টাকার পথে:
বীরপাড়া থেকে ভুটান ফুন্টসলিং

১৯৯৩ সাল। ভাগ্য পরিবর্তনের আশায় একদিন আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধুর সঙ্গে পা বাড়াই ভারতের পথে। আমাদের যাত্রার সূচনা বেনাপোল বর্ডার পেরিয়ে বনগাঁ শহরে। দিনটি ছিল বিশেষ—বাংলা বছরের প্রথম দিন, পহেলা বৈশাখ, ১৪০০ বঙ্গাব্দ

আমরা ছিলাম চারজন—আমি, আমার বন্ধু, আর তার দুই বোন। বনগাঁ থেকে রাত দশটার ট্রেনে চড়ে দমদমে পৌঁছাই প্রায় রাত বারোটায়। সেখান থেকে সরাসরি বন্ধুর আত্মীয়র বাড়িতে গিয়ে রাত কাটাই। পরদিন খুব ভোরে রওনা হলাম শিয়ালদা হয়ে বন্ধুর বাড়ি।

কয়েক সপ্তাহ পর বুঝলাম, সেখানে আমার আশার আলো নেই। সিদ্ধান্ত নিলাম—যেতে হবে উত্তরবঙ্গের বীরপাড়ায়, বড় দিদির বাড়িতে।

বীরপাড়া, জলপাইগুড়ি জেলার ছোট্ট একটি শহর। একসময় এই এলাকা ছিল চা-বাগানে ঘেরা। ধীরে ধীরে বাজার, মহল্লা, আর ঘন বসতির গড়ে ওঠা—সবই চা-বাগানের জমিতে। আমার বড় দিদির বাড়ি ছিল রবীন্দ্র নগর কলোনিতে

দিদি আমাকে চিনতে পারেননি প্রথমে। কারণ তার বিয়ের সময় আমার বয়স ছিল মাত্র দেড় বছর। ১৯৬৪ সালে দিদি ও জামাইবাবু ভারতে চলে যান এবং আর কখনো দেশে ফেরেননি। প্রায় ৩০ বছর পর সেই দিদির বাড়ি গিয়ে পরিচয় দিতেই মা-মায়ের মতো জড়িয়ে ধরেন।

দিদির বাড়িতে থেকেই ভাগিনাদের সঙ্গে গ্যারেজে কাজ শুরু করি। গ্যারেজের সুবাদে পরিচয় ঘটে বহু ট্রাকচালকের সঙ্গে। সুযোগ পেলেই বেরিয়ে পড়তাম আশপাশের জায়গায়—গুমটু, সামসি, শিলিগুড়ি, জলপাইগুড়ি, সেবক...।

তবে এক জায়গা থেকেই বারবার পিছিয়ে যাচ্ছিলাম—ভুটানের ফুন্টসলিং। বীরপাড়া থেকে মাত্র ২০ টাকার রাস্তা, অথচ যাওয়া হচ্ছিল না কাজের কারণে।

একদিন সকালবেলা, কাউকে কিছু না বলে বেরিয়ে পড়লাম। পকেটে ছিল মাত্র ২০০ টাকা। বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে ঘোরাঘুরি করতে করতে দেখি পরিচিত একটা বাস “জয়গাঁ, জয়গাঁ” বলে ডাকছে।

মনেই প্রশ্ন জাগল—জয়গাঁ কোথায়? পরে জেনেছি, জয়গাঁই ভারতের শেষ সীমান্ত শহর, ঠিক তার ওপারেই ভুটান—যার নাম ফুন্টসলিং। জয়গাঁ পৌঁছেই পায়ে হেঁটে ফুন্টসলিং শহরে প্রবেশ করা যায়।

এইভাবেই বিশ টাকার বিনিময়ে আমি ছুঁয়ে ফেলি ভুটানের সীমান্ত। এক অদ্ভুত অনুভূতি... পাহাড়, নীরবতা আর শৃঙ্খলিত জীবনযাপনের দেশ—ফুন্টসলিং।

[এটা ছিল না শেষ... বরং এক নতুন যাত্রার সূচনা]

ফুন্টসলিং শহরের প্রথম দর্শন

জয়গাঁ থেকে মাত্র কয়েক পা এগোলেই আরেকটি দেশ—ভুটান। কাঠের মতো গাঢ় রঙের প্রাচীর, থোড়া পাহাড়ি ঢালু, আর সীমান্তে দাঁড়িয়ে থাকা ইউনিফর্ম-পরা গার্ডের মৃদু হাসি—এভাবেই শুরু হয়েছিল আমার ফুন্টসলিং যাত্রা।

যাত্রীদের মতো আমিও পায়ে হেঁটে পেরিয়ে গেলাম সীমান্ত ফটক। কোনো পাসপোর্ট, ভিসা চেকের বালাই নেই তখনকার দিনে—বাংলাদেশি বা ভারতীয় নাগরিক হলে নিকটবর্তী শহর পর্যন্ত আসতে দেয় তারা। আমি তাই সাহস নিয়েই ঢুকে পড়লাম ভুটানের ফুন্টসলিং শহরে।

শহরে পা রাখতেই যে জিনিসটা সবচেয়ে চোখে পড়লো তা হলো পরিচ্ছন্নতা ও শৃঙ্খলা। রাস্তাঘাট ঝকঝকে, গাড়ি থামে ট্র্যাফিক সিগন্যাল মেনে, আর লোকজন যেন সবসময় শান্তভাবে কথা বলে। যেন এক আলাদা জগত।

সড়কের পাশে সারি সারি সুন্দর কাঠের ঘর, বেশিরভাগই তিনতলা—তবে প্রত্যেকটিতেই কাঠের নকশা, ঝুলন্ত ফুলের টব, রঙিন জানালা। এমন শহর জীবনে এই প্রথম দেখছি। চারপাশটা এতটাই নিঃশব্দ ও সুশৃঙ্খল ছিল যে, নিজের পায়ের শব্দও কানে লাগছিল।

একটি দোকানে ঢুকে কৌতূহল নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “ভুটানি টাকা নিতে পারি?” দোকানদার হেসে বলল, “ভুটানিজ এনজি (Ngultrum) আর ইন্ডিয়ান রুপি—দুটোই চলে।” দোকানে তখন ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম মজার সব জিনিস—ভুটানি হাতে বোনা কাপড়, কাঠের তৈরি মুখোশ, আর স্থানীয় চা।

এক জায়গায় দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ চারপাশ দেখছিলাম। পাহাড়ের গায়ে বসে থাকা এই শহরটা যেন নিজের মতো করেই স্বপ্নের মতো চলছিল—নীরব, শান্ত আর স্থির। ট্রাফিক নেই, হর্ন নেই, দৌড় নেই, হট্টগোল নেই। এই শহর যেন কানে কানে বলছে—“এখানে এসেছো বিশ্রাম নিতে, বিরাম পেতে।”

একটা স্থানীয় খাবারের দোকানে ঢুকে খেলাম ইমা দাচি—ভুটানের বিখ্যাত ঝাল চিজ কারি, সাথে লাল চালের ভাত। মজার ব্যাপার হলো, খাবারে ঝালের পরিমাণ এতটাই বেশি ছিল, তবুও সেটাই যেন এক নতুন স্বাদ, নতুন অভিজ্ঞতা।

সেই দুপুরবেলা ফুন্টসলিং শহরের রোদটা ছিল নরম—পাহাড়ের কোল ঘেঁষে এক ধরনের সোনালি ছায়া ফেলছিল। মনে হচ্ছিল আমি যেন কোনো ছবির ভেতর হেঁটে বেড়াচ্ছি।

সেই প্রথম ফুন্টসলিং দর্শন আজও চোখে ভাসে—স্মৃতি হয়ে, প্রশান্তির অনুভূতি হয়ে। কত শহর ঘুরেছি, কিন্তু এমন শান্ত শহর খুব কমই দেখেছি।

[ফুন্টসলিংয়ের গল্প এখানেই শেষ নয়… এক সন্ধ্যার পাহাড়ি চা-ঘরের গল্প আবার পরের দিনে]

লেখক পরিচিতি

নিতাই বাবু— একজন যাত্রাপ্রবণ গল্পকার ও ভ্রমণস্মৃতিকথা লেখক। ১৯৯৩ সালের ভুটান-ভারত সফর নিয়ে তার অন্তর্দৃষ্টি ও স্মৃতিচারণা বাংলাদেশের পাঠকদের মাঝে পরিচিত। নিতাই বাবু বাংলা সাহিত্য ও ব্লগিং জগতে তাঁর মধুর ভাষা ও সরলতা দিয়ে প্রিয় হয়ে উঠেছেন।

ফেসবুকে নিতাই বাবু নামে অনুসরণ করতে পারেন।

এই পোস্টটি শেয়ার করুন: ফেসবুক | টুইটার | হোয়াটসঅ্যাপ

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আমার শৈশবের বন্ধু— শীতলক্ষ্যা

একটি মাঠ; হাজারো প্রাণের স্মৃতি

মা নাই যার, সংসার অরণ্য তার