নগর খাঁনপুরের পুকুরপাড়ে


 নগর খাঁনপুরের পুকুরপাড়ে

শীতলক্ষ্যার কোলঘেঁষে একটি পুরনো মহল্লা—নগর খাঁনপুর। পাড়ার দক্ষিণ পাশে একটি বড় পুকুর, যার ঘাটে কাকভোরে আসে বৃদ্ধেরা স্নান করতে, আর দুপুরে নেমে পড়ে ছেলেরা জলে। এই পুকুরঘাটেই একদিন বিনয়ের জীবনের মোড় ঘুরে যায়।

বিনয় পাল—এক দরিদ্র হিন্দু পরিবারে জন্ম। বাবা ছিলেন নরসুন্দর, পুকুরপাড়ে কাঠের চৌকিতে বসে দাড়ি কামাতেন। বিনয় হাফশার্ট আর ছেঁড়া চটের ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যেত, স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে শিক্ষক হবার।

একদিন পুকুরঘাটে বসে থাকতেই হঠাৎ চোখে পড়ে এক অচেনা মেয়েকে—চুলে সাদা ফিতা, হাতে জলভরা কলসি। মেয়েটি জিজ্ঞেস করে, “এই পুকুরে সবাই গোসল করে?” বিনয় কিছু বলতে পারে না, শুধু চুপচাপ তাকিয়ে থাকে।

মেয়েটির নাম সুমনা সরকার—শহর থেকে বদলি হয়ে আসা বাবার সঙ্গে নতুন বাসা নিয়েছে নগর খাঁনপুরে। সেদিন থেকেই প্রতিদিন দেখা, গল্প, আর এক মধুর বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে পুকুরপাড়ে।

কিন্তু সুখ চিরকাল থাকে না। হঠাৎ একদিন সুমনা জানায়—তাদের আবার শহরে ফিরে যেতে হবে। শেষ বিকেলে পুকুরপাড়ে সুমনা বসে থাকে, চুপচাপ। বিনয় কাঁপা হাতে দেয় একটি কাঠের পেনসিলবক্স, তাতে খোদাই করা— "স্মৃতি তুমি আমার, সুমনা।"

সুমনা চোখ ভিজিয়ে বলে, “তুই ভুলবি না তো?”
বিনয় জবাব দেয় না। সে জানে—এই পুকুর, এই বিকেল, এই সিঁড়ি—সবই তার চিরন্তন অপেক্ষার স্মৃতি হয়ে থাকবে।

দশ বছর কেটে গেছে। পুকুরঘাট এখনও আছে, অশ্বত্থ গাছও আছে। বিনয় এখন স্কুলের সহকারী শিক্ষক। বিকেল হলে সে এখনও সেই ঘাটে এসে বসে। পকেটে রাখে সেই পুরনো কাঠের বাক্সের একটি খণ্ডিত অংশ। সে জানে, সুমনা হয়তো আর কখনও আসবে না।

কিছু বিকেল কখনও শেষ হয় না, কিছু পুকুরঘাটে চিরকাল বসে থাকে কেউ—একটু ফেরার অপেক্ষায়।


✍️ লেখক পরিচিতি

নিতাই বাবু একজন পুরস্কারপ্রাপ্ত নাগরিক সাংবাদিক এবং জনপ্রিয় ব্লগার।
তিনি ব্লগ ডট বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম-এ দীর্ঘদিন ধরে সমাজ, সংস্কৃতি, ইতিহাস এবং ভাষা বিষয়ক লেখালেখি করে আসছেন।
তাঁর লেখায় উঠে আসে জনজীবনের গভীর অনুভব, গ্রামীণ আবহ, ও হারিয়ে যাওয়া মানবিক গল্প।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আমার শৈশবের বন্ধু— শীতলক্ষ্যা

একটি মাঠ; হাজারো প্রাণের স্মৃতি

মা নাই যার, সংসার অরণ্য তার