এই বঙ্গদেশে একটি নদীর নাম শীতলক্ষ্যা
এই বঙ্গদেশে একটি নদীর নাম শীতলক্ষ্যা
বাংলার মানচিত্রে অসংখ্য নদ-নদীর ছাপ দেখা যায়, আর সেগুলোর প্রতিটিই যেন এই মাটির ইতিহাস, সংস্কৃতি ও সভ্যতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেইসব নদ-নদীর মধ্যে শীতলক্ষ্যা একটি উজ্জ্বল নাম, বিশেষ করে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক শহর নারায়ণগঞ্জ-এর সঙ্গে যার আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছে শত শত বছর ধরে।
শীতলক্ষ্যার জন্ম ও ইতিহাস
শীতলক্ষ্যা নদী একসময়ের প্রবল বেগে প্রবাহিত একটি শাখা নদী, যার উৎস গাজীপুর জেলার টঙ্গী থেকে। এই নদী মূলত ব্রহ্মপুত্রের একটি শাখা। নদীটি টঙ্গী, নারায়ণগঞ্জ হয়ে মেঘনা নদীতে গিয়ে মিশেছে। প্রাচীনকালে একে ‘লক্ষ্যা’ নামে ডাকা হতো, পরবর্তীতে এর শান্ত ও নির্মল প্রবাহের কারণে ‘শীতল’ শব্দটি যুক্ত হয়ে দাঁড়ায় ‘শীতলক্ষ্যা’।
মুঘল আমল থেকে শুরু করে ব্রিটিশ শাসনামল পর্যন্ত এই নদী ছিল বাংলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জলপথ। বাণিজ্য, পরিবহন, খাদ্য সরবরাহ ও সৈন্য চলাচলের জন্য শীতলক্ষ্যা ছিল অপরিহার্য। ইংরেজরা এ নদীকে কেন্দ্র করেই নারায়ণগঞ্জে স্থাপন করেছিল পাট গোডাউন, স্টিমার ঘাট ও রপ্তানি কেন্দ্র। এই নদীর দুই তীরে গড়ে উঠেছিল বিখ্যাত পাটকল, বস্ত্রকল, ছাপাখানা ও অন্যান্য কলকারখানা।
নদীর সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক ভূমিকা
শীতলক্ষ্যা শুধু বাণিজ্যের নদী নয়—এ নদী সাহিত্য ও সংস্কৃতির সাথেও গভীরভাবে জড়িত। কবি, সাহিত্যিক, চিত্রশিল্পী, আবৃত্তিকার ও সংগীতশিল্পীরা এই নদীর রূপ ও ব্যথা নিয়ে বহু সৃষ্টি উপহার দিয়েছেন। ‘শীতলক্ষ্যার জলে সূর্য ডুবে যায়, আর জেগে ওঠে নীরবতা’—এই ধরনের পংক্তি বহু কাব্যে উচ্চারিত হয়েছে। নদীর পাড়ে বসে জন্ম নিয়েছে গান, কবিতা ও প্রেম।
বর্তমান অবস্থা—চরম দুঃখের চিত্র
একসময়ের স্বচ্ছজল শীতলক্ষ্যা আজ দূষণে, দখলে আর অবহেলায় প্রায় মৃতপ্রায়। প্রতিদিন শত শত কারখানা তাদের বর্জ্য নির্গমন করে নদীতে। ট্যানারি, কেমিক্যাল ফ্যাক্টরি, ডাইং ও অন্যান্য শিল্পপ্রতিষ্ঠান এই নদীর প্রাণশক্তিকে শুষে নিচ্ছে। পানির রং কালচে, তীব্র গন্ধে নাক টেকে না। এই নদীতে এখন মাছও টেকে না, জীবনশক্তি হারিয়ে ফেলেছে শীতলক্ষ্যা।
দখলদারদের দৌরাত্ম্য এতটাই বেড়েছে যে নদীর বুকেও গড়ে উঠেছে অবৈধ স্থাপনা। এক সময়কার খেয়াঘাট ও কাশবন আজ আর নেই। নদীর পাড়ে নেই সেই আগের প্রাণচাঞ্চল্য।
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা—আছে আলোর দিশা
সব ধ্বংসের মাঝেও এখনো আশার আলো আছে। যদি সরকার, নাগরিক ও পরিবেশবাদীরা একযোগে কাজ করে, তবে শীতলক্ষ্যাকে আবারও জীবন দেওয়া সম্ভব। প্রথমেই প্রয়োজন হবে—
- নদী দখলমুক্ত করা
- শিল্প বর্জ্য শোধনের জন্য ইটিপি (Effluent Treatment Plant) বাধ্যতামূলক করা
- নদীর ড্রেজিং করে নাব্যতা ফিরিয়ে আনা
- নদীপাড়ে গড়ে তোলা সবুজ বেষ্টনী ও নান্দনিক ওয়াকওয়ে
- পর্যটন সম্ভাবনার সদ্ব্যবহার করা
বিশ্বের অনেক উন্নত শহরে নদীকে ঘিরে যে সৌন্দর্য ও নাগরিক জীবনের প্রাণ গড়ে উঠেছে, আমাদের শীতলক্ষ্যাও হতে পারে তেমনই এক নদীকেন্দ্রিক শহরায়নের মডেল।
উপসংহার
এই বঙ্গদেশে শীতলক্ষ্যা একটি নদীর নাম মাত্র নয়, এটি এক আত্মপরিচয়, এক নীরব সাক্ষ্য বহনকারী ইতিহাস। এ নদী বাঁচলে বাঁচবে শহর, বাঁচবে জীবন, বাঁচবে সংস্কৃতি। তাই এই নদীকে বাঁচাতে হবে দায়িত্ব, ভালবাসা ও সম্মিলিত প্রয়াসে। ভবিষ্যৎ প্রজন্ম যেন নদী বলতে শুধু পাঠ্যবইয়ের ছবি নয়, জলের ধ্বনি শুনে নদীর গল্প বুঝতে পারে—সেই আশাই আজকের মূল বার্তা।
– নিবেদিত এক নদীসন্তান
লেখক: নিতাই বাবু
পুরস্কারপ্রাপ্ত নাগরিক সাংবাদিক
ব্লগ ডট বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম -এর নিয়মিত লেখক
সহযোগিতায়: ChatGPT, OpenAI
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
nitaibabunitaibabu@gmail.com