ডাক্তার একদম আলীর ভুল চিকিৎসার খেসারত
একজন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারের কম্পাউন্ডারের নাম কদম আলী। কদম আলীর লেখাপড়া মোটামুটি। কিন্তু বড় ধরনের কোনও ডিগ্রি তার ছিল না। তবুও তার ঔষধের দিকেই ছিল বেশি মনোযোগ। তাই উঠতি বয়স থেকেই নিজের এলাকায় থাকা একজন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারের দোকানে বলে-কয়ে চাকরি নেয়। তার কাজ হলো প্রেসক্রিপশন দেখে রোগীকে ঔষধ বুঝিয়ে দেওয়া।
কদম আলী ঔষধের দোকানে চাকরি নেওয়ার পর থেকে খুব সুনামের সাথেই কাজ করে যাচ্ছিল। কদম আলীর আশা, একদিন সেও একজন হোমিওপ্যাথিক ডাক্তার হবে। দিবে ঔষধের দোকান। বসবে কোনও এক চেম্বারে। করবে অনেক টাকা রোজগার।
তাই তার নজর থাকে ডাক্তারের দিকে। ডাক্তার রোগী দেখে, রোগীর কথা শুনে, কোন রোগের জন্য কোন শিশির ঔষধ লিখে; তা কদম আলী খেয়াল করে মুখস্থ করে রাখে। সময়-সময় প্রেসক্রিপশন হাতে পেয়ে রোগীকে জিজ্ঞেস করে, আপনার রোগটা কী? রোগী যদি বলে মাথাব্যথা, তা কদম আলী মনের খাতায় লিখে রাখে—মাথাব্যথার ঔষধ এটা!
এভাবে পাঁচ থেকে ছয় বছর কদম আলী খুব মনোযোগের সাথে রোগ নিরাময়ের ঔষধ এবং করণীয় সবকিছু মুখস্থ করে ফেলেছে। এখন কদম আলীকে ডাক্তারের বেশি কিছু বুঝিয়ে দিতে হয় না। কদম আলী ডাক্তারের দেওয়া প্রেসক্রিপশন দেখে ফটাফট ঔষধ বানিয়ে রোগীকে বুঝিয়ে দিতে পারে।
একদিন এক রোগী পেটব্যথায় আক্রান্ত হয়ে এই হোমিওপ্যাথিক ডাক্তারের দোকানে আসে। ডাক্তার রোগী দেখে প্রেসক্রিপশনে লিখে রেখেছিলেন, ৩ নম্বর শিশি থেকে ৫ ফোঁটা, আর ৪ নম্বর শিশি থেকে ৫ ফোঁটা, ৫ গ্রাম পাউডারের সাথে মিশিয়ে (৬+৬) ১২টি পুরিয়া বানিয়ে রোগীকে দিতে হবে। রোগী ৪ ঘণ্টা পরপর ১ পুরিয়া করে সেবন করবে। একদিন পর আবার রোগীকে ডাক্তারের কাছে আসতে হবে। রোগীর অবস্থা দেখে ডাক্তার পরবর্তী ব্যবস্থা নেবেন। প্রয়োজনে নতুন ঔষধ দেবেন।
কদম আলী প্রেসক্রিপশনের লেখা অনুযায়ী ৩ নম্বর শিশি আর ৪ নম্বর শিশি থেকে ৫ ফোঁটা করে বিশেষ পাউডারের সাথে মিশিয়ে ১২ পুরিয়া ঔষধ বানিয়ে রোগীকে বুঝিয়ে দিল। রোগী ঔষধ নিয়ে বাড়ি চলে গেল।
রোগী বাড়ি গিয়ে ডাক্তারের দেওয়া ঔষধ ৪ ঘণ্টা পরপর সেবন করে চললেন। ঔষধ সেবনের পর রোগী মোটামুটি সুস্থ হয়ে উঠলেন। আগের মতো তেমন আর পেটব্যথা নেই। তবু রোগীর মনের ভয় যাচ্ছিল না। কারণ ডাক্তার বলেছিলেন, একদিন পর আবার আসতে। ডাক্তার যদি বলেন, “আপনি এখন পুরোপুরি সুস্থ”, তাহলেই রোগীর মন থেকে রোগ বিষয়ে সন্দেহ দূর হবে। এই ভেবে রোগী আবার ডাক্তারের দোকানে আসলেন।
ডাক্তার সেদিন দোকানে নেই। গেছেন শহরে ঔষধ আনতে। দোকানে আছে কম্পাউন্ডার কদম আলী। কদম আলী রোগীকে দেখে হাসতে হাসতে বলল,
— কী খবর ভাইজান, কেমন আছেন, পেটব্যথা সেরেছে?
— সেরেছে কম্পাউন্ডার সাহেব। তো, ডাক্তার সাহেব কোথায়?
— কেন? ডাক্তার সাহেবকে কী দরকার? তিনি শহরে গেছেন ঔষধ আনতে। যা বলার আমাকে বলতে পারেন। কোনও সমস্যা নেই!
— না মানে, ঐ যে ডাক্তার সাহেব বলেছিলেন আবার আসতে!
— আবার আসতে বলেছিলেন এই কারণে, যদি আপনার পেটব্যথা না সারে তাই। এখন আপনার কি পেটব্যথা আছে? যদি থাকে তো আমিই ঔষধ দিয়ে দিতে পারব।
— আমি এখনও পুরোপুরিভাবে সুস্থ হইনি। মাঝেমধ্যে চিনচিন করে ব্যথা করে। আপনি যদি পারেন, তাহলে আমাকে ঔষধ দিয়ে দিন।
রোগীর কথা শুনে কদম আলী খুশিতে আটখানা। মনে মনে বলল, “এতো বছর ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন দেখে ঔষধ বানাতে বানাতে কি কিছুই শিখিনি?”
ডাক্তারের লেখা মনে পড়ে—৩ নম্বর শিশি থেকে ৫ ফোঁটা, ৪ নম্বর শিশি থেকে ৫ ফোঁটা, আর ৫ গ্রাম পাউডার মিশিয়ে ১২ পুরিয়া।
এই ভেবে কদম আলী আলমারি থেকে ৩ নম্বর ও ৪ নম্বর শিশি বের করতে গেল। কিন্তু দেখে দুই শিশিই খালি। তখন তার মাথায় এক ‘বুদ্ধি’ আসে—৩+৪=৭! আর ৫+৫=১০ ফোঁটা! আর ৫+৫=১০ গ্রাম পাউডার!
ব্যস! ৭ নম্বর শিশি থেকে ১০ ফোঁটা, ১০ গ্রাম পাউডারের সঙ্গে মিশিয়ে ১২ পুরিয়া বানিয়ে রোগীকে দিল। বলল, আগের নিয়মেই সেবন করতে।
রোগী খুশি হয়ে ঔষধ নিয়ে বাড়ি গেল।
কিন্তু ঔষধ সেবনের কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হলো পেটব্যথা, বমি ও পাতলা পায়খানা। রোগীর চিৎকারে আশপাশের লোকজন ছুটে এলো। রোগী বিস্তারিত খুলে বললেন।
রাগে-ক্ষোভে শতাধিক মানুষ ছুটে এল ডাক্তারের দোকানে।
কদম আলী ভাবছে, “লোকজন বুঝি আমাকে দেখতে এসেছে!”
বলতেই,
— জ্বি হ্যাঁ, আমি কদম আলী!
এই বলেই শুরু হলো কিল-ঘুষি!
কদম আলী চিৎকার করে বলতে লাগলো, “মাগো... বাবাগো...”
ঠিক তখনই ডাক্তার শহর থেকে ঔষধ নিয়ে ফিরে এলেন।
শতাধিক লোকের ভিড় দেখে দৌড়ে এলেন।
জানতে চাইলেন, কী হয়েছে?
সব শুনে ডাক্তার নিজের কম্পাউন্ডারকে বললেন, “তুমি কী করেছো?”
কদম আলী বলল,
— রোগী আগের রোগেই এসেছিল। ৩ আর ৪ নম্বর শিশি খালি দেখে ৭ নম্বর শিশি থেকে ১০ ফোঁটা দিয়ে ১০ গ্রাম পাউডারের সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছি। ৩+৪=৭ তো!
— আমি ঔষধ বেশি দিইনি! বরং একটাতেই দিয়েছি! এই হিসাব তো আমারই শিখানো!
এই কথা শুনেই ডাক্তার নিজের মাথায় হাত দিয়ে বলল, “ধ্বংস! ৭ নম্বর শিশির ঔষধ তো বিষ! সেটা দেওয়া হয় সাপের কামড় বা বিষ পান করলে! রোগী তো মারা যেত!”
ডাক্তার সঙ্গে সঙ্গে ঔষধের বাক্স নিয়ে রোগীর বাড়ির দিকে ছুটলেন। গিয়ে রোগীকে বিষনাশক ঔষধ খাইয়ে, কিছু ডোজ দেওয়ার পর অবস্থা সামাল দিলেন।
ফিরে এসে কদম আলীকে বললেন,
— এখনই দোকান ছেড়ে চলে যাও। বাড়ি গিয়ে দিনমজুরি করো, হাল চাষ করো।
ডাক্তারি এতো সহজ নয়!
ডাক্তার হতে হলে চিকিৎসা বিজ্ঞানের জ্ঞান থাকতে হয়।
তোমাদের মতো ভুয়া ডাক্তারের ভুল চিকিৎসায় মানুষ মরছে।
সিজার করার সময় মায়ের মৃত্যু, নবজাতকের মৃত্যু—সব পত্রিকায় প্রকাশ পায়।
আর এর পেছনে থাকে তোমাদের মতো ভুয়া ডাক্তারদের ভুল সিদ্ধান্ত।
ভাগ্য ভালো, আজ আমি সময়মতো ফিরে এসেছিলাম।
---
📌 প্রিয় পাঠক, লেখা ভালো লাগলে অনুগ্রহ করে লাইক/কমেন্ট ও শেয়ার করে উৎসাহ দিন।
✍️ নিতাই বাবু, নাগরিক সাংবাদিক ও ব্লগার,
ব্লগ.bdnews24.com
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
nitaibabunitaibabu@gmail.com