বেশি বুদ্ধি কুঁকড়িমুকড়ি মাধ্যম বুদ্ধি চিত্তরং

         ব্যাঙের ঈশ্বর ভাবনা বুদ্ধি পানির মধ্যে ধপ্পরং!

বেশি বুদ্ধি কুঁকড়িমুকড়ি, মাধ্যম বুদ্ধি চিত্তরং, ঈশ্বর ভাবনা বুদ্ধি পানির মধ্যে ধপ্পরং।

উপরোল্লিখিত লেখাভপড়ে অনেকেই ভাবছেন, কুঁকড়িমুকড়ি, চিত্তরং, ধপ্পরং এগুলো আবার কী? হ্যা পাঠক, এই তিনটে শব্দের অর্থ মাহাত্ম্য জানতে আপনাকে পোস্টের লেখার শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়তে হবে। তা হলেই উপর বর্ণিত শব্দার্থ বুঝতে পারবেন।

তার আগে বলে রাখা ভালো যে, উপর বর্ণিত তিনটি শব্দের অর্থ বোঝাতে হলে একটা গল্পের মাধ্যমে বুঝাতে হবে। তো চলুন, গল্পটা শুরু করা যাক↓↓↓

একজন সরকারি চাকরিজীবীর সন্তান বলতে একটি ছেলেই ছিলো । একটি মেয়ের জন্য মহান সৃষ্টিকর্তার দরবারে অনেক বাসনা করেছিল, কিন্তু মেয়ে আর তাদের ভাগ্যে জোটেনি। বৃদ্ধ বয়সে চাকরিজীবী লোকটা মারা গেলো। মৃতব্যক্তির একমাত্র ছেলে ওয়ারিশ সূত্রে তার স্থাবর অস্থাবর টাকা-পয়সার মালিক হলো। সরকারি চাকরিজীবী লোকটা মারা যাওয়ার পর তার একমাত্র ছেলেটা গ্রামের বাড়িতে গিয়ে বাড়ির সব  দলিলপত্র বুঝে নিলো।

বিরাট বড় বাড়ি! বাড়ি ছাড়াও চাষাবাদের জমিও আছে অনেক! বাড়ির চার-পাশেই চাষাবাদের জমিজমা। ঐ জমিজমা গুলো ছেলেটার বাবা বেঁচে থাকতেও গ্রামের মানুষ দিয়ে চাষাবাদ করানো হতো।

এরমধ্যে বাড়ি ঘেঁষা পাঁচ একর জমি সবসময়ই খালি থাকতো। এতে বছরের পর বছর এতবড় জমিটা খালি পড়ে থাকতে থাকতে সুন্দরবনে পরিণত হয়ে গেলো। দীর্ঘদিন ধরে চাষাবাদ না করার ফলে, পুরো পাঁচ একর জমিতে ছোট-বড় গাছ-গাছালি আর আগাছা পরগাছায় একাকার হয়ে আছে। হঠাৎ কেউ দেখলে এই পাঁচ একর জমি চাষাবাদের জমি বলবে না। বলতে হবে এটা একটা ছোট অরণ্য।

ছেলেটা শহর থেকে গ্রামে গিয়ে বাড়ির পাশের পরিত্যক্ত জমিটা দেখে বলছে, 'এতো বড় জমিটা এভাবে বছরের পর বছর ধরে এমন করে ফেলে রাখা তো ঠিক হচ্ছে না! জমিতে জন্মানো আগাছাগুলো পরিস্কার করে এখানে ধান গম ভুট্টা-সহ অনেকরকম ফসলের চাষ করা সম্ভব! কিন্তু বর্তমানে এতো বড় সুন্দরবন পরিস্কার করতেও তো অনেক টাকার প্রয়োজন। তারচেয়ে বরং জমিতে জন্মানো আগাছা পরগাছাগুলেতে কেরোসিন তেল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দিবো।

এতে করে জমির আগাছা পরগাছা পুড়ে চাই হয়ে মাটিতে মিশে জমির উর্বরতা বাড়বে, ধান গম ভুট্টা চাষে ফসলও ভালো হবে। সেই ফসল বিক্রি করে বছর শেষে অনেক টাকা আয় করা যাবে। এভাবে এই জমিটা আর ফেলে রাখা যায় না। আগামীকালই কয়েক লিটার কেরোসিন তেল এনে জমির চারদিকে ছিটিয়ে আগুন লাগিয়ে দিবো। তারপরই জমিতে চাষাবাদ করা শুরু করবো। এই বলেই ছেলেটা পরিত্যক্ত জমির সামনে থেকে বাড়ি চলে গেলো।

জমির মালিকের এই কথা প্রথমে শুনলো, দীর্ঘদিন ধরে এই জমিতে বাস করা এক সাপ। এই পরিত্যক্ত জমিতে শুধু সাপই থাকে না, সাপের সাথে থাকে এক কাছিম আর এক ব্যাঙ। এরা তিন প্রাণী একে অপরের বন্ধু। থাকেও মিলেমিশে। এরা দীর্ঘদিন ধরে এই জমিতেই একসাথে বসবাস করে আসছিল। ওরা যে যা-কিছু করতো, একে অপরের সাথে বুঝেশুনেই করতো। সাপ জমির মালিকের এই কথা শুনে সাথের বন্ধুদের খুঁজতে লাগলো!

  জঙ্গলে বাস করা তিন বন্ধু সাপ, ব্যাঙ ও কচ্ছপ 

সাপ দৌড়াচ্ছে আর মনে মনে দুই বন্ধুর কথা ভাবছে! ❝জমির মালিক বলে গেল, আগামীকাল এই বনভূমিতে আগুন লাগিয়ে মরুভূমিতে পরিণত করবে। তারপর জমির মালিক এখানে নতুন করে চাষাবাদ শুরু করবে। তাহলে এই বনে আমরা যারা দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করছি, আমাদের কী হবে? আমি নাহয় আমার বুদ্ধির কারণে বেঁচেই যাবো। কিন্তু আমার সঙ্গের সাথী দুই বন্ধু কাছিম আর ব্যাঙের অবস্থাই বা কী হবে?❞

এই নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে কাছিম আর ব্যাঙকে খুঁজতে লাগলো। অনেক খোঁজা-খুঁজির পর সাপ কাছিম আর ব্যাঙের দেখা পেলো। সাপ কাছিম আর ব্যাঙের কাছে সবকিছু খুলে বললো। তারপর বাসভূমির বর্তমান অবস্থা নিয়ে সাপ জরুরি মিটিং ডাকলো। মিটিঙের সময় নির্ধারণ করা হলো, দুপুর ২ টায়।

   সাপের বেশি বুদ্ধি! তাই সে হবে কুঁকড়িমুকড়ি!

যথাসময়ে সাপ আসলো। কাছিম আসলো। ব্যাঙও আসলো। তিন প্রাণী একসাথে বসলো। সাপ কাছিম আর ব্যাঙকে জিজ্ঞেস করলো, “তরা ত হুনছতই, জমির নতুন মালিক যে কইয়া গেলো!”

কাছিম বললো, “হ রে ভাই হুনছি। আমি তহন জমির কিনারেই আছিলাম। তগো বহুত বিছরাইছি। হের পরে ত তর লগেই দেখা অইয়া গেছেগা। অহনে আবার তুই আমাগো ডাক দিছত। আমাগো লাইগা তর এই মায়া দেইখা তরে গুরু মানতে মন চাইতাছে।”

সাপ দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললো, “থাক ভাই, গুরু আর মানতে অইবো না। গুরু হাজনের আর সময়ও নাইক্কা। জমির মালিক গুরু অওনের সময় আমারে আর বুঝি দিলো না। অহনে জান বাঁচানই ফরজ অইয়া সামনে আইছে। রাইত পোহাইলেই অন্য কোনোহানে যাওন লাগবো। অহনে আমি ভাবতাছি তগো দুইজনরে লইয়া। তগো যে কী দশা অইবো, হেইডাই আমি চিন্তা কইরা কূল-কিনারা পাইতাছি না।”

সাপের কথা শুনে কাছিম বললো, “এত বছর ধইরা তিনজনে মিল্লা এক জাগাত আছিলাম। অহনে যার জাগা হেয় যদি হের নিজের জাগাত আগুন লাগাইয়া দেয়, তয়লে ত আর কিচ্ছু করনের নাই। হেয় যদি হের জাগাত  কারোরে থাকতে না দেয়, তয়লে কি জোর কইরা থাওন যাইবোরে ভাই? অহনে তুই ক দেহি হুনি! বেয়াইন্নাবেলা যদি আগুন লাগাইয়া দেয়, তুই তর জান কেমনে বাঁচাইবি?" সাপকে জিজ্ঞেস করলো কাছিম।

         কচ্ছপের মাধ্যম বুদ্ধি! সে হবে চিত্তরং।

কাছিমের কথা শুনে সাপ হাসতে হাসতে বললো, “হা হা হা, আমি করি হেগো চিন্তা, আর হেরা করে আমার চিন্তা! হুন বেডা কাউট্টা, জমির মালিক জঙ্গলের চারদিকে আগুন লাগানের পরেও আমি জঙ্গলে মাধ্যে চুপ কইরা বইয়া থাকুম। চাইরোদিক তুনে আগুন জ্বলতে জ্বলতে যহনে আমার সামনে আইবো, তহনে আমি দৌড় দিমু। আমি যেই চালুর চালু! শোঁ কইরা আগুনের উপরে দি লাফাইয়া লাফাইয়া উইড়া জঙ্গল পার অইয়া যামুগা, বুঝলি? মরলে তরা দুইডাই মরবি রে ভাই!”

সাপের কথা শুনে ব্যাঙ মহাশয় কিছুই বললো না। শুধু মনে মনে হায় ঈশ্বর! হায় ঈশ্বর! করতে লাগলো।

কাছিম বললো, “আরে হাপ ভাই হুইন্না লয়! আমার লাইগা তুই ভাই চিন্তা করিছ না। আমার কিচ্ছু অইত না। আমার পিট যেই শক্তের শক্তরে ভাই! আমি আগুনের মধ্যে হুইয়া থাকলেও আমার পিট গরম অইত না। আমি আগুনের উপরে দি আঁইট্টা আঁইট্টা জঙ্গল পাড় অইয়া যামুগা। মরলে মরবে আমগো এই ব্যাঙ মশাই। অর যে কী অইবো রে ভাই, ভাইবা পাইতাছি না।”

ব্যাঙ মশাই তখনো চুপচাপ থাকলো। ব্যাঙ শুধু মনে মনে ঈশ্বরকেই ডাকতে লাগলো!

সাপ আর কাছিম দুইজনেই ব্যাঙকে জিজ্ঞেস করলো, 'কী রে ব্যাঙ ভাই, তুই কিচ্ছু কইতাছত না ক্যা? আমরা ত তর চিন্তাই করতাছি! জমির মালিক যদি সত্য সত্য আগুন লাগাইয়া দেয়, তয়লে তুই কী করবি? ক দেহি হুনি!”

ব্যাঙ মনখারাপ করে কাঁদা কাঁদা স্বরে বললো, “কী আর করুমরে ভাই! ঈশ্বর যদি আমারে কৃপা না করে, তয়লে আমার আর রইক্ষা নাই। জমির মালিক হের জমির মাধ্যে আগুন লাগাইলে, আমি জঙ্গলের মাধ্যে বইয়া বইয়া শুধু ঈশ্বররে ডাকতে থাকুম। ঈশ্বর আমারে রইক্ষা করলে কইরবো, না করলে নাই। আমার লাইগা তরা চিন্তা করিছ না, ভাই। তগো জান তরা কেমকে বাঁচাইবি, হেই চিন্তা কর।”

       ব্যাঙের ঈশ্বর ভাবনা বুদ্ধি! তাই সে বেঁচে যাবে।

ব্যাঙের কথা শুনে সাপ আর কছিম বললো, “যা, বেডা ব্যাঙা। তুই ঈশ্বর ঈশ্বর কইরা মর! আমরাও আমগো চিন্তা করি!”

এসব কথাবার্তার মধ্যদিয়ে জঙ্গলে থাকা তিন প্রাণী সাপ, কাছিম আর ব্যাঙের গোল মিটিং শেষ হলো।

এরপর যে যার জায়গায় চলে গেল। বিকেল গড়িয়ে রাত হলো। রাত শেষে সকাল হলো। জমির মালিক আগের দিনের কথামতো কয়েক ব্যারেল কেরোসিন তেল সাথে নিয়ে পরিত্যক্ত জমির সামনে এলো। এরপর পিচকারি দিয়ে জমির চারদিকে কেরোসিন তেল ছিটিয়ে দিয়ে আগুন লাগিয়ে দিলো।

আগুন লাগানোর পর পাঁচ একর জমির চারদিক সমান তালে দাউদাউ করে জ্বলতে লাগলো। জঙ্গলের ভেতরে ঠিক মাঝখানে সাপ, কাছিম, ব্যাঙ বসে বসে দেখতে লাগলো। এভাবে আগুন জ্বলতে জ্বলতে যখন জঙ্গলের মাঝামাঝি স্থানে গেল, তখন সাপের শরীরে একটু আগুনের তাপ অনুভূত হলো।

সাপ তখন কাছিমকে বলছে, “আরে বেডা তুই অহনো এনো বইয়া রইছত! ব্যাঙের চিন্তা না কইরা, তাততাড়ি কইরা দৌড় দে। আপনা জান বাঁচা! নয়লে তর আর রইক্ষা নাই। ব্যাঙের লগে তর অ মরণ গালবো। আমি চললাম! যদি বাঁইচা থাহি, তয়লে আবার দেখা অইবো। বাই বাই! টা টা!”

এই বলেই সাপ আগুনের উপর দিয়ে শোঁ শোঁ করে দৌড়াতে লাগলো। অল্প কিছুদূর যেতে-না-যেতেই সাপ বাহাদুর আগুনে পুড়ে কুঁকড়িমুকড়ি হয়ে গেল!

সাপের পিছনে পিছনে কাছিম ধীরগতি থেকে একটু স্প্রিরিট বাড়িয়ে দ্রুতগতিতে আগুনের ভেতর দিয়ে হাঁটতে লাগলো। কাছিমও অল্প কিছুদূর যেতেই, হাত পা পুড়ে চিৎ হয়ে গেল!

ব্যাঙ মহাশয় এখন জঙ্গলের ভেতরে বসে একা একা ঈশ্বরকে ডাকতে শুরু করলো। ঈশ্বরকে ডাকতে ডাকতে ব্যাঙের চোখ গেলো এক গর্তের দিকে। সেই গর্তে কিছু বৃষ্টির পানি ছিল। ব্যাঙ ঈশ্বর ঈশ্বর বলতে বলতে সেই গর্তে এক লাফ দিয়ে ধপ্পর করে পড়লো!

কিছুক্ষণ পর আস্তে আস্তে জমিতে লাগানো আগুনে সব গাছগাছালি পুড়ে ছাঁই হয়ে আগুন নিভে গেলো। এরপর ব্যাঙ মহাশয় যেই গর্তে আশ্রয় নিয়েছিল, সেই গর্তের জমাট পানি কিছুটা ঠান্ডা হলো। ব্যাঙ আস্তে-ধীরে ঈশ্বর ঈশ্বর বলে গর্ত থেকে উপরে উঠলো।

ব্যাঙ উপরে উঠে  চারদিকে তাকাতে লাগলো। সাপ আর কাছিমকে খুঁজতে শুরু করলো। ব্যাঙ এদিক সেদিক তাকাতে তাকাতে দেখলো, একটু দূরে সাপ বন্ধু কুঁকড়িমুকড়ি হয়ে ছাঁইয়ের উপর পড়ে আছে।

এর একটু সামনেই বন্ধু কাছিম আগুনে পুড়ে চিৎ হয়ে পড়ে আছে। ব্যাঙ সাপের মরদেহের সামনে গিয়ে বললো, “বেশি বুদ্ধি কুঁকড়িমুকড়ি!”
ব্যাঙের সামনে গিয়া বললো, “মাধ্যম বুদ্ধি চিত্তরং!”
আমি হলাম ঈশ্বর ভাবনা বুদ্ধি, তাই করেছি "পানির মধ্যে ধপ্পরং!”

এর মানে হলো, জঙ্গলে থাকা সাপের ছিল বেশি বুদ্ধি! সে আগুনে পুড়ে হলো, “কুঁকড়িমুকড়ি”।
কাছিমের ছিল মাধ্যম বুদ্ধি। সে আগুনে পুড়ে হলো, “চিত্তরং”।
ব্যাঙের বুদ্ধিশুদ্ধি কিছুই ছিল না। যা-ই ছিল সবই ঈশ্বরের উপর! তাই ব্যাঙের হলো, "ঈশ্বর ভাবনা বুদ্ধি, পানির মধ্যে ধপ্পরং”।

প্রিয় পাঠক আশা করি লেখার প্রথমাংশে উল্লেখিত তিনটি শব্দের অর্থ মাহাত্ম্য বুঝতে পেরেছেন। বেশি বুদ্ধির ফল কী, আর মাধ্যম বুদ্ধির ফল কী এবং ঈশ্বর ভাবনা বুদ্ধির ফল কী হতে পারে, তা একটু ভেবে আপনার মতামত মন্তব্যে প্রকাশ করলে, আমার লেখা স্বার্থক হবে।

প্রিয় পাঠক, লেখা পড়ে ভালো লাগলে দয়াপূর্বক লাইক/কমেন্ট ও শেয়ার করে বাধিত করবেন।

নিতাই বাবু:
ব্লগ ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম,
সোনেলা ব্লগ শব্দনীড় ব্লগ।
২৪/০৫/২০২৩ইং।

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

nitaibabunitaibabu@gmail.com

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আমার শৈশবের বন্ধু— শীতলক্ষ্যা

একটি মাঠ; হাজারো প্রাণের স্মৃতি

মা নাই যার, সংসার অরণ্য তার