দুইজন অন্ধ ভিখারির কথোপকথন
বর্তমানে আমাদের দেশে ভিক্ষাবৃত্তি হলো, বিনা পুঁজিতে লাভজনক এক ব্যবসা। যাদের কিছুই বলতে নেই, তারাই এই লাভজনক ব্যবসার সাথে জড়িত থাকার কথা। কিন্তু এখন এখন এই ব্যবসার থাতে জড়িত হয়ে পড়েছে যাদের অনেককিছুই আছে, তারাও। এমনও দেখা যায় গার্মেন্টসে চাকরি করে ছুটির অবসরে বোরকা পরে রাস্তায় হাত পেতে দাড়িয়ে থাকে। অসহায় ভেবে মানুষ হাঁটা-চলার সময় স্বচ্ছল স্বাবলম্বী ভিখারির হাতে কিছু-না-কিছু দিয়ে যায়, ছওয়াবের আশায়। কেউ আবার রুগী সেজে বড়সড় মার্কেটের সামনে, রাস্তার পাশে, হাট-বাজারে, পাড়া-মহল্লার অলিগলিতে মুখ ঢেকে শুয়ে থাকে। পথচারী পথচলার মাঝে দিয়ে যায়, অসহায় ভেবে যে যা পারে। আসলে কিন্তু এরা কেউ দিন দুখি নয়! এরা বদ স্বভাবের দুখি। তাহলে এদের মধ্যে সত্যিকারের ভিখারি কারা?
এদের মধ্যে ভিখারি বা ভিক্ষুক হলো, যাদের চোখ নেই, হাত নেই, পা নেই তারা। তাদের মধ্যে দুইজন ভিখারির কথোপকথন আমার এই লেখায় তুলে ধরছি। তো শুরু করার আগে দুজন ভিখারির সাথে সবাইকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি। একজন হলো, ভিক্ষুক আনোয়ার। আরেকজন হলো, ভাসানী। তারা দুইজনই কিন্তু অন্ধ! তো চলুন শুরু করা যাক!
ভিক্ষুক আনোয়ার যখন রাস্তায় বের হয়, তখন তার হাতে একটা লাঠি থাকে। তার হাতে থাকা লাঠিটা জাতিসংঘ থেকে দেওয়া বিশেষ ধরনের এক লাঠি। সেই লাঠি দিয়ে ঠুকে ঠুকে আনোয়ার গ্রামের হাটবাজার-সহ বাড়িতে বাড়িতে হেঁটে হেঁটে ভিক্ষা করে। ভিক্ষুক আনোয়ার যখন ঠুক ঠুক করে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যায়, তখন ভিক্ষুক আনোয়ার আল্লাহ রাসূলের নাম ধরে সুর তোলে–
'হায় আল্লা তুই ছোবাহান
হায়াতের মালিক।
হায় আল্লা তুই ছোবাহান
হায়াতের মালিক।'
ভিক্ষুক আনোয়ার'র মুখে সেই মধুর সুর শুনে মানুষ তার হাতে টাকা দেয়, পয়সা দেয়। কেউ কেউ রুটি কলা খাবারও কিনে দেয়। একদিন আনোয়ার বাড়ি থেকে ভিক্ষা করতে বের হলো। সকাল থেকে ভিক্ষা করতে করতে দুপুর হয়ে গেলো। দুপুরের খাওয়া-দাওয়া ভিক্ষা করার মাঝে পরের বাড়িতেই হয়। দুপুরের পর বিকাল হতে লাগলো। এখন তো ভিক্ষুক আনোয়ার'র বাড়ি ফেরার পালা। তাই ভিক্ষুক আনোয়ার বাড়ি আসার পথ ধরে ঠুক ঠুক করে হেঁটে আসছিল, "হায় আল্লা তুই ছোবাহান হায়াতের মালিক" বলতে বলতে।
যেই রাস্তা দিয়ে ভিক্ষুক আনোয়ার হেঁটে যাচ্ছিল, সেই রাস্তার দুইপাশে গাছ-গাছালি, একটু পরপর খাল-বিল, ডোবা-নালা। রাস্তার পাশে যা-ই থাকুক, রাস্তা কিন্তু ভিক্ষুক আনোয়ার'র খুবই পরিচিত ছিল। কারণ, এই রাস্তা দিয়েই সবসময় ভিক্ষুক আনোয়ার হাঁটা-চলা করে থাকে, তাই রাস্তাটি তাঁর চেনা-জানা। ভিক্ষুক আনোয়ার হেঁটে যাচ্ছে নিজের মতে। সেই রাস্তা দিয়েই পাশের গ্রামের এক অন্ধ ভিক্ষুক বিপরীত দিক দিয়ে হেঁটে আসছে। সেও সারাদিন ভিক্ষা করে তার বাড়ি ফিরছিলো।
পাশের গ্রামের ভিক্ষুক ভিক্ষা করার সময় আল্লাহ রাসূলের নামে মুখে কোনও সুর তোলে না। এই ভিক্ষুক শুধু জিকিরের সুরে বলতে থাকে–
'দেইখেনো ভাই আমি ভাসানী,
দেইখেনও ভাই আমি ভাসানী।'
এছাড়া আর কিছুই সে বলতো না। এতেই মানুষ বুঝে নিতো অন্ধ ভিক্ষুকটা ভিক্ষা করতে এসেছে। তারপর কেউ ভিক্ষা দিতো, কেউ মাপ চেয়ে নিতো। এখন এই দুইজন অন্ধ ভিক্ষুক যার যার ভাবে একই রাস্তা দিয়ে দুইদিক থেকে হেঁটে আসছে। পাশের গ্রামের ভিক্ষুক বলছে–
'দেইখেনও ভাই আমি ভাসানী,
দেইখেনও ভাই আমি ভাসানী।'
এই বলতে বলতে ভিক্ষুক তাঁর হাতের লাঠি দিয়ে ঠুকে ঠুকে এগিয়ে আসছে, ভিক্ষুক আনোয়ার'র দিকে।
ভিক্ষুক আনোয়ার বাঁশ আনি বাঁশ আনি শুনে মনে করলো কেউ হয়তো লম্বা বাঁশ কাঁধে করে রাস্তা দিয়ে হেঁটে আসছে। এই ভেবে ভিক্ষুক আনোয়ার আস্তে আস্তে রাস্তার কিনারে চাপতে লাগলো। যাতে বাঁশের খোঁচা-খাঁচি শরীরে না লাগে। এভাবে ভিক্ষুক আনোয়ার রাস্তার কিনারে চাপতেই থাকলো, চাপতেই থাকলো। আর পাশের গ্রামের ভিক্ষুকও জিকিরের সুরে বলতে লাগলো–
'দেইখেনও ভাই আমি ভাসানী,
দেইখেনও ভাই আমি ভাসানী।'
ভিক্ষুক আনোয়ার এবার চিন্তা করতে লাগলো, শালার বাঁশ মনে হয় লম্বালম্বি করে না এনে আড়াআড়িভাবে নিয়ে আসছে। তাই হয়তো জোরে জোরে চিল্লাচ্ছে, বাঁশ আনি, বাঁশ আনি। এই ভেবে ভিক্ষুক আনোয়ার তাঁর গায়ে বাঁশ লাগার ভয়ে তাড়াতাড়ি রাস্তার ঢালে নামতে শুরু করলো। নামতে নামতে একেবারে খালের পানিতে গিয়ে নামলো। তারপরও পাশের গ্রামের ভিক্ষুক বলছে–
'দেইখেনও ভাই আমি ভাসানী,
দেইখেনও ভাই আমি ভাসানী।'
এভাবে ভিক্ষুক আনোয়ার পাশের গ্রামের ভিক্ষুককে সাইট দিতে দিতে যখন খালের মাঝামাঝি গেল, তখনও পাশের গ্রামের ভিক্ষুক বলছে–
'দেইখেনও ভাই আমি ভাসানী,
দেইখেনও আমি ভাসানী।'
এবার অন্ধ ভিক্ষুক আনোয়ার ভীষণ ক্ষেপে গেল! রেগেও গেল! আনোয়ার রেগে-মেগে বললো–
'আরে মিয়া আম্নের কান্দের বাঁশখান কত লম্বা হে? আমি হালায় অন্ধ মানুষ। চোক্ষে দেখি না। শল্লের মাধ্যে বাঁশের খোঁচ-খাঁচি লাগবো দেইখ্যা, রাস্তা তুনে নাইমতে নাইমতে খালের মধ্যখানে যাইয়া খারাইয়া রইছি। হের পরেও কইতাছেন, দেইখেনও ভাই বাঁশ আনি, দেইখেনও ভাই বাঁশ আনি? আমি কি অখনে খাল হাতরাইয়া হেপাড় যাইয়া বইয়া থাকুম?'
আনোয়ার'র মুখে বাঁশের কথা শুনে পাশের গ্রামের ভিক্ষুকও বাঁশের ভয়ে কাঁপছে! শালার বাঁশ কেডা আনতাছে? কোনদিক দা যে আইতাছে! আবার শরীরে বাঁশ লাগে কিনা, সেই ভয়েও পাশের গ্রামের ভিক্ষুক রাস্তার কিনারে চাপতে লাগলো। কাঁপতে কাঁপতে আর চাপতে চাপতে আনোয়ার'র সামনা-সামনি রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে জোরে জোরে বলতে লাগলো–
'দেইখা যাইয়েনও ভাই আমি ভাসানী।
দেইখা যাইয়েনও ভাই আমি ভাসানী।'
এভাবে পাশের গ্রামের ভিক্ষুক শরীরে বাঁশ লাগার ভয়ে ভিক্ষুক আনোয়ার'র কাছাকাছি চলে গেলো। এবার খালের মাঝখান থেকে ভিক্ষুক আনোয়ার বলছে–
'আরে ভাই আপ্নের বাঁশ নেওয়া অইছেনি ও?'
পাশের গ্রামের ভিক্ষুক বলছে–
'দেইখা যাইয়েনও ভাই আমি ভাসানী।'
ভিক্ষুক আনোয়ার এবার আরও ভয় পেয়ে গেল! কারণ, বাঁশ আনি বাঁশ আনি কথাটা খুবই সামনা-সামনি শোনা যাচ্ছে। তাই ভিক্ষুক আনোয়ার খালের আরও গভীরে যেতে যেতে বললো–
'হালার আজগা যে কোন অলক্ষ্মীর মুখ দেইখা ঘরের তুন বাইর অইছি, কইতে পাইল্লাম না। আইজগা কি আমারে বাঁশেই পাইছে? এই হালার বাঁশ কতক্ষণে যাইবো রে, মাবুদ?'
ভিক্ষুক আনোয়ার'র এই কথা পাশের গ্রামের ভিক্ষুক শুনে বললো–
'ভাই, মনে অইতাছে আরও অনেক সময় লাগবো।' ভিক্ষুক আনোয়ার বললো–
'ভাই তাড়াতাড়ি আম্নেগো বাঁশ সরান। আমারে বাইত যাইতে দেন। রাইত অইয়া গেলে ক্যামনে যামু গো ভাই!'
এবার পাশের গ্রামের ভিক্ষুক এখন আনোয়ার'র সামানা-সামনি এসে জিজ্ঞেস করলো–
'ভাইসাব বাঁশ আনতাছে কেডা ও? আপ্নে কি তাগো চিনেন? এই রাস্তা দিয়াই কি বাঁশ আনতাছে? নাকি নৌকা কইরা খাল দিয়া বাঁশ নিতাছে?'
ভিক্ষুক আনোয়ার' রেগে-মেগে বললো–
'ও-ই মিয়া, এতক্ষণ বাঁশ আনি বাঁশ আনি কইরা চিল্লাইছে কেডা ও?'
পাশের গ্রামের ভিক্ষুক নরম সুরে বললো–
'আমিই ত ভাসানী ভাসানী কইয়া আইতাছিলাম। তয় ভাই সাব, আমার লগে ত কোনও বাঁশ টাস নাই। আম্নে বাঁশের ডরে খালে নাইম্মা রইছেন কিল্লাইগা?'
ভিক্ষুক আনোয়ার বললো–
'আরে মিয়া আম্নে না কইলেই বাঁশ আনি বাঁশ আনি? ইল্লাইগা আমি হালায় আম্নেরে সাইড দেওনের লাইগা রাস্তার তুনে নাইমতে নাইমতে খালের মধ্যে যাইয়া খারাইয়া রইছি। এহনে কইতাছেন আম্নের গলে বাঁশ টাস নাই। ফাইজলামি করনের আর জাগা পান না মিয়া? আমি অন্ধ দেইখা আমার লগে ইয়ার্কি করেন? আল্লায় বিচার করবো মিয়া। আল্লায় বিচার করবো। এক দিনকা আম্নেও কানা অইবেন, কইয়া দিলাম।'
ভিক্ষুক আনোয়ার'র কথা শেষ হতে-না-হতে পাশের গ্রামের ভিক্ষুক বললো–
'আরে ভাইসাব আমিও তো এক কানা মানুষ। আমি হারাদিন ভইরা ভিক্ষা টিক্কা কইরা খাই। বাঁশ টাস পামু কই? আমিতো বাঁশের কথা কিচ্ছু কই নাইক্কা। আম্নে হুদাহুদি কিল্লাইগা খালে যাইয়া নাইমছেন? আম্নের মুহে বাঁশের কথা হুইন্না আমিও হালায় খালের কিনারে আইয়া খারাইছি।'
এবার ভিক্ষুক আনোয়ার ভিজা কাপড়ে খাল থেকে আস্তে আস্তে উপরের দিকে উঠছে আর বলছে–
'ও-ই মিয়া আম্নে কই? হাতের লাডি দিয়া আম্নেরে লাগুর পামু নি? কই আম্নে, কই?'
এই বলেই ভিক্ষুক আনোয়ার হাতে থাকা জাতিসংঘের লাঠি এদিক সেদিক ঘোরাচ্ছে।
আর বলছে, 'আম্নেরে আগে দুইখান বাড়ি মাইরা লই। হালা মিত্থুক! এতক্ষণ বাঁশ আনি বাঁশ আনি কইরা চিল্লান নাই? আমি চোক্ষে দেখি না দেইখা কী অইছে? কানেও কি আর কম হুনি?'
পাশের গ্রামের ভিক্ষুক বললো–
'আরে ভাই আম্নে এতো চেত্তাছেন কে হুনি? এনো চেতনের কী অইলো? চেইতেন না ভাইসাব, চেইতেন না! আমার নামইত ভাসানী। আমিও আম্নের মতন কানা অন্ধ ভাইসাব। অন্ধ দেইখা রাস্তায় আঁডাচলার মাধ্যে এই কথা কইয়াই চলি। যাতে মাইনষে বুঝবার পারে আমি ভাসানী আইতাছি।'
এবার অন্ধ ভিক্ষুক আনোয়ার নিজের কপালে নিজে থাপ্পড় মারতে মারতে বলতে লাগলো–
'হায়রে কয়াল আমার! যেই বাঁশের ডরে নাইমতে নাইমতে খালে যাইয়া নামছি। হেই বাঁশ অইছে ভাসানী। আবার এই হালাও নাকি আমার মতো কানা। হালার নামও নাকি ভাসানী। অন সেনা বুঝলাম বাঁশ টাশ কিছুই না, আসলে এই হালার নাম ভাসানী। আর আমি হালায় কোন আহাম্মকের আহাম্মক! হালার বাঁশ আনি বাঁশ আনি হুইন্না বাঁশের ডরে নামছি খালে।' এইডা কি একটা কাম অইলো? হালার দুই কানার কারবার!' এই কারবার মাইনষে হুনলে কি কইবো?'
এই বলেই অন্ধ ভিক্ষুক আনোয়ার বললো, 'ভাই আম্নে কই? আইয়েন দুই কানায় কোলাকুলি কইরা লই। হেরপর বাইত যামুনে।'
এই বলেই দুই অন্ধ ভিক্ষুক হাতে হাত মিলিয়ে, আর বুকে বুক মিলিয়ে হ্যাণ্ডশেক করে দুই ভিক্ষুক দুইদিকে যারযার মতো করে যেতে লাগলো।
প্রিয় পাঠক, লেখা পড়ে ভালো লাগলে দয়াপূর্বক
লাইক/কমেন্ট ও শেয়ার করে বাধিত করবেন।
নাগরিক সাংবাদিক ও ব্লগার,
ব্লগ ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
০৬/০৫/২০২৩ইং।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
nitaibabunitaibabu@gmail.com