মোগল স্থাপত্য বিবি মরিয়ম মাজার রয়ে গেলো আড়ালে আবডালে

       হযরত বিবি মরিয়ম মাজার। নারায়ণগঞ্জ। 

একসময় নারায়ণগঞ্জের নাম ছিল বিশ্বজুড়ে। সেই প্রাচীনকাল থেকেই নারায়ণগঞ্জ সারা দুনিয়ার মানুষের কাছে সুপরিচিত। নারায়ণগঞ্জে মোগল আমলের স্থাপত্য এখনো অনেক জায়গায় কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।

আছে ঈশা খাঁর রাজধানী নামে খ্যাত সোনারগাঁও-এর পানাম নগরীর পুরানো স্থাপত্য, ঈশা খাঁর স্ত্রী সোনাবিবির মাজার, পাঁচবিবির মাজার, গিয়াস উদ্দিন আযম শাহের সমাধি, ইব্রাহীম দানিশমান্দ-এর দরগা, বন্দর উপজেলার নবীগঞ্জের কদম রসূল দরগাহ-সহ হাজীগঞ্জ কেল্লা। তারমধ্যে একটি হলো হযরত বিবি মরিয়ম সমাধিসৌধ বা হযরত বিবি মরয়ম মাজার। 

হযরত বিবি মরিয়ম মাজার। কিল্লার পুল, নারায়ণগঞ্জ। 

এই সমাধিসৌধটি স্থানীয় মানুষের কাছে বিবি মরিয়ম মাজার নামেই বেশি সুপরিচিত। বিবি মরিয়ম সমাধি বা মাজারটি নারায়ণগঞ্জের হাজীগঞ্জ এলাকার কিল্লারপুল ঘেঁষা অবস্থিত। নারায়ণগঞ্জ টু ডেমরা-চিটাগাং রোড আসা-যাওয়ার মাঝপথেই কিল্লার পুল ও বিবি মরিয়ম মাজারটির অবস্থান।

কিল্লার পুল হলো নারায়ণগঞ্জের একটা ঐতিহ্যবাহী পুল। যা হাজীগঞ্জ কেল্লার নামে নামকরণের ফলে পুলটির নাম হয় কিল্লার পুল। হাজীগঞ্জ কেল্লাটিও প্রাচ্যের ডান্ডি নারায়ণগঞ্জের ইতিহাসের একটা ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা। হাজীগঞ্জ কেল্লা বা হাজীগঞ্জ দুর্গ নিয়ে আরও আগে আমি একটা লেখা পোস্ট করেছি। সেই পোস্টের লিংক এখানে দেয়া হলো। আজকে বিবি মরিয়ম মাজার নিয়ে কিছু লিখতে চাই। সেই সাথে সবাইকে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই, এই ঐতিহ্যবাহী প্রাচীনতম বিবি মরিয়ম সমাধিসৌধ বা মাজারটির সাথে।

হযরত বিবি মরিয়ম মাজার। কিল্লার পুল নারায়ণগঞ্জ। 

এই বিবি মরিয়ম মাজার এলাকায় ছিল আমাদের  বাসস্থান। তাই এই মাজারটির সাথে মিশে আছে আমার আত্মা, মন-প্রাণ সবই। একসময় আমার অবসর সময় কাটানের স্থান ছিল এটি। এই মাজারের আশে-পাশেই অবসর থাকা সময় কাটাতাম। যেমন- শুক্রবার কিংবা কোনও সরকারি ছুটির দিনের সময়টা।

এই মাজারের সুবিশাল প্রাচীর ঘেঁষা উত্তর পাশে ছিল, ফাইন টেক্সটাইল মিলস্। ফাইন টেক্সটাইল মিলে আমি অনেকদিন কর্মরত ছিলাম। বর্তমানে ফাইন টেক্সটাইল এখন আর এখানে নেই। ফাইন টেক্সটাইল মিলস্ এখন মুন্সিগঞ্জ চান্দের বাজার সংলগ্ন আউটশাহী এলাকায় হস্তান্তরিত। সেখানেও কিছুদিন কাজ করেছিলাম। যাক সেসব কথা, আসা যাক বিবি মরিয়ম সমাধিসৌধ বা মাজার প্রসঙ্গে।

ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, বিবি মরিয়মের সমাধি মুঘল আমলে নির্মিত একটি সমাধিসৌধ। এটি তৎকালীন মুঘল সম্রাট নিয়োজিত সুবেদার শায়েস্তা খাঁন কতৃক নির্মিত বলে ধারণা করে থাকেন ঐতিহাসিকরা । ঐতিহাসিকরা এ-ও ধারণা করেন যে, এই সমাধিসৌধটি ও এর লাগোয়া মসজিদের নির্মাণ কাল ১৬৬৪-৮৮ খৃষ্টাব্দে। সমাধিতে শায়িত ‘বিবি মরিয়ম’কে তৎকালীন বাংলার মুঘল সুবাদার শায়েস্তা খানের কন্যা এবং ইরান দখত এর বোন তুরান দখত হিসেবে মনে করেন।

হযরত বিবি মরিয়ম মাজার। কিল্লার পুল নারায়ণগঞ্জ। 

সমাধিসৌধটি সুউচ্চ প্রাচির দিয়ে ঘেরা একটি আয়তাকার প্রাঙ্গনের মাঝখানে ভুমি থেকে অনেক উচুতে নির্মিত। বর্গাকার ইমারতটিতে একটি বিশালাকার গম্বুজও রয়েছে। এছাড়াও সমাধিসৌধ বা মাজার ভবনের চারদিকে খিলান ছাদ বিশিষ্ট বারান্দা, আর অনেকগুলো জানালা রয়েছে। মাজারটির কেন্দ্রস্থলে চতুষ্কোণ কক্ষে রয়েছে তিন ধাপ বিশিষ্ট সমাধি। সমাধিটি শ্বেত পাথরে নির্মিত ও লতা পাতার নকশা অঙ্কিত। এছাড়াও মাজারের বারান্দায় বেশ কয়েকটি সাধারণ কবরও রয়েছে। যা সমাধিসৌধটির সামনে গেলেই সবার চোখে পড়ে ।

এছাড়াও রয়েছে সমাধিসৌধটির পশ্চিম পাশে তিন গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ। যার নির্মাণকাল সমাধিসৌধটির সমসাময়িক অর্থাৎ ১৬৬৪- ৮৮ খৃষ্টাব্দে। এটিও শায়েস্তা খাঁন নির্মাণ করেছিলেন বলে ঐতিহাসিকরা মনে করেন। তার কারণেই হয়তো সমাধিতে শায়িত ‘বিবি মরিয়ম’ এর নামেই একে ‘বিবি মরিয়ম’ এর মসজিদ নামকরণ করা হয়েছে। 

    বিবি মরিয়ম মাজার অভ্যন্তরে থাকা মসজিদ। 

স্বাধীনতা পরবর্তি সময় থেকে মাজার ঘেঁষে গড়ে ওঠেছে ‘বিবি মরিয়ম’ সমাধির নামে একটি বিদ্যালয়। বিদ্যালয়টির  নাম, বিবি মরিয়ম উচ্চ বালিকা বিদ্যালয়। বিদ্যালয়টি বিবি মরিয়ম মাজারের সুবিশাল প্রাচীরের ভেতরেই। এছাড়াও মাজারের চারপাশ ঘেরা প্রাচীর ঘেঁসে স্থায়ীভাবে গড়ে ওঠেছে অনেক দোকানপাট।

বর্তমানে সন্ধ্যা হলেই সমাধিসৌধটি হয়ে পড়ে একটা ভুতুড়ে বাড়ির মতো। সমাধিসৌধটি ছাড়া এর আশেপাশে কোনো লাইট বা কোনো আলোর ব্যবস্থা নেই। সমাধিসৌধ সংলগ্ন মসজিদে লাইট থাকলেও পুড়ো সমাধিসৌধটি জায়গা থাকে অন্ধকার। বিবি মরিয়ম সমাধিসৌধটির চারদিকে স্থায়ীভাবে দোকান-পাট, শিল্প প্রতিষ্ঠান, জনবসতি গড়ে ওঠার কারণে এই ঐতিহ্যবাহী পবিত্র মাজারটি রয়ে গেছে লোকচক্ষুর আড়েলে।

হযরত বিবি মরিয়ম মাজার অভ্যন্তরে থাকা সুবিশাল গেইট। কিল্লার পুল নারায়ণগঞ্জ। 

বর্তমানে এটি নিয়ন্ত্রন দেখভাল করছে, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, ঢাকা বিভাগ। কিন্তু বহু প্রাচীনতম এই সমাধিসৌধটির কোনো সংস্কার হচ্ছে না বহুবছর ধরে। যার কারণে সমাধিসৌধটির প্রাচীরের পুরানো ইটগুলো ধসে পড়ছে। সেইসাথে মাজারটির দেয়ালে পড়ছে শেওলা। ধারণা করা যায়, যখন এই সমাধিসৌধটি তৈরি করে তখন কোনো সিমেন্টের আবিষ্কার হয় নাই, বা তখন কোনো সিমেন্ট-ই ছিলনা। সেইজন্যই পুড়ো সমাধিসৌধটি চুনা আর সুরখি দিয়ে নির্মিত হয়।

হযরত বিবি মরিয়ম মাজারের বারান্দায় থাকা কয়েকটি সাধারণ কবর। কিল্লার পুল নারায়ণগঞ্জ। 

তাই অনেক পুরানো স্থাপনা হওয়াতে সমাধিসৌধটির প্রাচীর সহ এর মূল স্থাপনাও শেওলায় ঢাকা পড়ে যায়। একযুগ বা দুই যুগ পরে রাষ্ট্রের সুনজরে শুধু সমাধিসৌধটি কিছুটা সংস্কার হলেও, এর পাশে থাকা স্থাপনাগুলো সংস্কারবিহীন পড়ে থাকে যুগযুগ ধরে। আর মোঘল আমলের নির্মিত ঐতিহ্যবাহী বিবি মরিয়ম মাজারটি পড়ে থাকে আড়ালে আবডালে।


প্রিয় পাঠক, লেখা পড়ে ভালো লাগলে দয়াপূর্বক লাইক/কমেন্ট ও শেয়ার করে বাধিত করবেন। 

নিতাই বাবু,
নাগরিক সাংবাদিক ও ব্লগার,
ব্লগ ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
সোনেলা ব্লগ শব্দনীড় ব্লগ।
১৪/০৫/২০২৩ইং।

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

nitaibabunitaibabu@gmail.com

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আমার শৈশবের বন্ধু— শীতলক্ষ্যা

একটি মাঠ; হাজারো প্রাণের স্মৃতি

মা নাই যার, সংসার অরণ্য তার