অযত্নে অবহেলায় দাড়িয়ে আছে নারায়ণগঞ্জের হাজীগঞ্জ কেল্লা।
এটি নারায়ণগঞ্জ থেকে চিটাগাং রোড যেতে মাঝপথে নবীগঞ্জ গুদারা ঘাটের একটু সামনেই, হাজীগঞ্জ ফায়ার ব্রিগেডের পরই হাজীগঞ্জ কেল্লাটির অবস্থান। কোনো একসময় এটি খিজিরপুর দুর্গ নামেও সবার কাছে পরিচিত ছিল। নারায়ণগঞ্জ সিটির হাজীগঞ্জ এলাকায় শীতলক্ষ্যার পশ্চিম তীরেই এই ঐতিহ্যবাহী কেল্লাটি অযত্নে অবহেলায় এখনো কালের সাক্ষী হয়ে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।
নারায়ণগঞ্জ-চিটাগাং রোড ভায়া ডেমড়া আসা-যাওয়ার পথিমধ্যে এই কেল্লাটি সবার চোখে পড়ে। দেশ স্বাধীন হবার আগে থেকে এই কেল্লাটির চারপাশে গড়ে উঠেছিল টিনসেট পাটের গোডাউন। সেসময় নারায়ণগঞ্জ পাট ও বস্ত্রশিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল।
এখন সেই নাম-কাম না থাকলেও, কেল্লাটির চারপাশে কিছুকিছু দখলদারি স্থাপনা এখনো দিব্বি রয়ে গেছে। এসব দখলদারি স্থাপনাগুলোর জন্য মোগল আমালের প্রাচীনতম এই কেল্লা অনেকেরই চোখে পড়ে না। কাজেই ইতিহাস ঐতিয্যের সৌন্দর্য হারাতে বসেছে মোগল স্থাপত্য এই কেল্লাটি।
জানা যায়, কোনও একসময় ঢাকা শহর কে রক্ষা করতে এই কেল্লাটি নির্মিত হয়। সপ্তদশ শতকের আগে পরে যে তিনটি জল দুর্গকে নিয়ে ত্রিভূজ জল দুর্গ বা ট্রায়াঙ্গল অব ওয়াটার ফোর্ট গড়ে তোলা হয়েছিল। তারই একটি হলো এই হাজীগঞ্জ দুর্গ বা কেল্লা।
সম্ভবত মুঘল সুবাদার ইসলাম খান কর্তৃক ঢাকায় মুঘল রাজধানী স্থাপনের পরে নদীপথে মগ ও পর্তুগীজ জলদস্যুদের আক্রমণ প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে এই দুর্গটি নির্মাণ করেছিলেন। জলদুর্গের বৈশিষ্ট্য মন্ডিত দুর্গটি শীতলক্ষ্যার সঙ্গে পুরাতন বুড়িগঙ্গার সঙ্গমস্থলে নির্মিত হয়। কেল্লাটি চতুর্ভুজাকৃতির।
কেল্লাটিতে কয়েকটি প্রবেশদ্বার আছে। প্রবেশদ্বারগুলো দেখে মনে হয়, রাজা, বাদশাহ বা সম্রাটরা নৌযান থেকে নেমেই; খুব অল্পসময়ের মধ্যেই কেল্লায় পৌঁছে যেতে সক্ষম হতো। কেল্লাটি সুউচ্চ প্রাচীর ঘেরা। প্রাচীরের ভেতরের সাইটে আছে, প্রায় তিন হাত চওড়া সরু রাস্তা। মনে এই রাস্তা দিয়ে সৈন্যদল হাঁটতো আর কেল্লার বাইরে নজর রাখতো।
প্রাচীরে রয়েছে বন্দুক ঢুকিয়ে গুলি বা বল্লম ছোড়ার উপযোগী ফোঁকর। আরও আছে চারকোণে গোলাকার বুরুজ। চারকোণের প্রতিটি বুরুজের অভ্যন্তরভাগে দুর্গ প্রাচীরের শীর্ষ পর্যন্ত বিস্তৃত সিঁড়ি। এই বুরুজে কর্তব্যরত প্রহরীরা পাহারা দিতো। আছে কামান বসানোর উপযোগী সুউচ্চ বেদীর অবস্থান, যা দুর্গটির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।
কেল্লাটির ভেতরে বিশাল জায়গা। দেখে মনে হয় এ যেন একটা ফুটবল খেলার মাঠ। হয়তো এই মাঠেই সৈন্যদল ট্রেনিং অথবা শত্রুপক্ষের সাথে যুদ্ধ করতো। মাঠের এক কোণে একটা সুরঙ্গপথ বিদ্যমান সাদৃশ্য। জানা যায় এই সুরঙ্গপপথ নাকি শীতলক্ষ্যা নদীর পূর্বপাড়ে অবস্থিত বন্দর কেল্লার সাথে সসংযোগ ছিল। বিপদের আশংকা টের পেলে সৈন্যদল এই সসুরঙ্গপথ দিয়ে অন্য কেল্লায় পলায়ন করত।
তবে বর্তমানে সুরঙ্গটি পুরোপুরিভাবে বন্ধ আছে। এই কেল্লাটি দক্ষিণ পাশে একটি খাল রয়েছে। এই খাল দিয়ে সেসময়ের রাজপ্রতিনিধিরা তাদের রাজকীয় নৌযান নিয়ে কেল্লায় আসতো। তাই এই খালটির নামকরণ করা হয়েছে কেল্লা খাল।
নারায়ণগঞ্জ টু ডেমড়া সড়কের মাঝেপথেই এই খাল। মানুষ আর যানবাহন চলাচলের জন্য এই খালের উপরে প্রাচীন আমলেই একটা ব্রিজ তৈর করা হয়েছিল। হাজীগঞ্জ কেল্লার নামানুসারে এই ব্রিজের নামকরণ করা হয় কিল্লার পুল। যদিও সেই পুরাতন ব্রিজটি ভেঙে নতুন করে ব্রিজ নির্মিত হয়েছে, তবুও সেই আগেকার কিল্লার পুল নামে সবার কাছে পরিচিত।
ব্রিজটির পাশেই রয়েছে বিবি মরিয়মের সমাধিস্থান। যা বিবি মরিয়মের মাজার নামে সবার কাছে পরিচিত। জানা যায় সমাধিতে শায়িত বিবি মরিয়মকে তৎকালীন বাংলার মুঘল সুবাদার শায়েস্তা খানের কন্যা এবং ইরান দখত এর বোন তুরান দখত হিসেবে ঐতিহাসিকরা ধারনা করে থাকেন।
হাজীগঞ্জ কেল্লাটির উত্তর পাশে এম সার্কাস নামক স্থানে রয়েছে একটি শাহী মসজিদ। মসজিদটি এম সার্কাস শাহী মসজিদ নামে সুপরিচিত। জানা যায়, আগেকার সময়ে কেল্লায় আসা রাজপ্রতিনিধিরা এই শাহী মসজিদেই নামাজ আদায় করতো। তাই এই মসজিদটি স্থানীয় মানুষের কাছে শাহী মসজিদ নামে পরিচিতি লাভ করে।
বর্তমানে ঐতিহ্যবাহী হাজীগঞ্জ কেল্লাটি রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বিলীন হতে বসেছে। হাজীগঞ্জ গুদারাঘাট বা নবীগঞ্জ গুদারাঘাট হতে কেল্লায় প্রবেশ করার সিঁড়িটিও খসে খসে পড়ছে। একবার শুনেছিলাম নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সম্মানিতা মেয়র ডা. সেলিনা হায়াৎ আইভী এই ঐতিহ্যবাহী কেল্লার চারপাশ দখলমুক্ত করে পুনরায় কেল্লার ভেতরে ও বাইরে পার্ক নির্মাণ করার উদ্যোগ নিয়েছে। তারপর নারায়ণগঞ্জ আসা-যাওয়ার সময় দেখা গিয়েছিল, কিছুকিছু স্থাপনা উচ্ছেদ করেছে। তা দেখে ভেবেছিলাম, হয়তো আর কিছুদিন পরই এই ঐতিহ্যবাহী কেল্লা লোকচক্ষুর নজরে পড়বে। কিন্তু না, এখনো এই ঐতিহ্যবাহী কেল্লার চারপাশ পুরোপুরিভাবে দখলমুক্ত হয়নি। ফলে যেই হালের কেল্লা, সেইভাবেই প্রাচীরের গায়ে শেওলা মেখে কালের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে। আর খসে খসে পড়ছে।
এভাবে খসে খসে পড়তে থাকলে হয়তো কোনোএক দিন প্রাচ্যের ডান্ডি নামে খ্যাত নারায়ণগঞ্জের হাজীগঞ্জ এলাকার এই প্রাচীন মোগল স্থাপত্য কেল্লাটি একদিন বিলীন হয়ে যাবে। তাই এখন থেকেই স্থানীয় প্রশাসনের উচিৎ মোগল আমলের স্থাপনা কেল্লাটির রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব নেওয়া। তা না হলে হয়তো একদিন কেল্লাটি আর কারোর চোখেই পড়বে না। এমনটা যাতে না হয়, সেই আশাই করছি।
প্রিয় পাঠক, লেখা পড়ে ভালো লাগলে দয়াপূর্বক
লাইক/কমেন্ট ও শেয়ার করে বাধিত করবেন।
ব্লগ ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম,
০৯/০৫/২০২৩ইং।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
nitaibabunitaibabu@gmail.com