একটি সমাধিস্থল মঠ ও একটা বটগাছের জন্মকথা

ছবিটি পাগলা সাধুর সমাধিস্থলের মঠকে ঘিরে রাখা একটা বটগাছ। 

একটি বটগাছের পরম মমতায় কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে পাগলা সাধুর সমাধিস্থানে নির্মিত একটি মঠ। মঠটি ঘিরে কথিত আছে অনেক জানা অজানা কথা। সেসব কথা নাহয় লেখার শেষাংশে প্রকাশ করবো। শুরুতে সুশীতল ছায়াসুনিবিড় দেববৃক্ষ বটগাছ নিয়ে কিছু লিখে জানাতে চাই।

বটগাছ একটি বৃহদাকার বৃক্ষ জাতীয় উদ্ভিদ৷ আমাদের দেশের গ্রাম ও শহরে বট গাছ সাধারণত দুই প্রকারই বেশি দেখা যায়। কাঁঠালিবট ও জিরাবট৷ কাঁঠালি বটের পাতা ঠিক কাঁঠাল পাতার মতো। আর জিরাবটের পাতা পানপাতার মতো দেখা যায়। তাই দুইরকমের বটগাছের দুইটি নাম হয়েছে জিরাবট, আর কাঁঠালি বটগাছ। 

কাঁঠালি বট ও জিরাবট এই দুই প্রকারের বটগাছ আমাদের দেশের শহর-বন্দর, গ্রাম-গঞ্জের আনাচে-কানাচে অনেক দেখা যায়। সবচেয়ে বেশি দেখা যায় পুরানো বাড়ির দেয়ালের কার্নিশে, প্রাচীর ঘেরা দেয়ালের ফাটলে। 

বাউন্ডারি দেয়ালের ফাটলে অথবা পুরোনো স্থাপনার দেয়ালে বটগাছ জন্মানোর কারণ হচ্ছে, আগেকার সময়ে সিমেন্ট না থাকার কারণে ইটের দালান তৈরি হতো, ইটের সুরকীর সাথে চুন মিশিয়ে। 

ইটের সুরকীর সাথে চুন মিশিয়ে স্থাপনা তৈরি করার একটা কারণও ছিলো। কারণ হলো, আগেকার সময়ে সিমেন্টের খুবই দাম ছিল। দাম ছিল এই কারণে যে, তখনকার সময়ে আমাদের দেশে কোথাও কোনও সিমেন্ট ফ্যাক্টরি ছিল না। কোনও জমিদার বংশের কারোর সিমেন্টের দরকার হলে, বিদেশের কথা স্মরণ করতে হতো। তাই সিমেন্ট ছিল বিদেশি এক দুর্লভ পণ্য। যেই পণ্য তখনকার দিনে যেকেউ কিনতে সক্ষম হতো না বা পারতো না। 

আগের দিনে যার কাছে এক হাজার টাকা থাকতো তাকে বলতো হাজার টাকার মালিক। আর যিনি থাকতো কয়েক হাজার টাকার মালিক, তাকে লোকে বলতো হাজারী। 

ওইসব হাজারীদের হাজার হাজার টাকা থাকতেও, তাঁরা বিদেশ থেকে সিমেন্ট এনে তাদের বসতবাড়ি, দালান-কোঠা রড-সিমেন্ট দিয়ে তৈরি করতে পারেনি। তৈরি করতে হয়েছে মোটা মোটা এঙ্গেলের সাহায্যে। আর সিমেন্টের পরিবর্তে সুরকীর (ইটের ফাঁকি) সাথে চুনা মিশিয়ে পেঁকমাটির মতন করে ছোট ছোট ইটের সাথে লেপে তাদের স্থাপনাগুলো তৈরি করেছে। 

কেউ কেউ চুনের খরচের টাকা বাঁচাতে সুরকির পরিবর্তে  আঠালো মাটির সাথে ইট গেঁথে বড়সড় দালানকোঠা তৈরি করছে। ওইসব দালান-কোঠা মাটি আর ইটের সুরকি দিয়ে তৈরি বলেই, এসব দালান-কোঠার দালানে, বাড়ির বাউন্ডারি ওয়ালে শেওলা জমে থাকতো।

সেই শেওলা থেকে সৃষ্টি হতো একধরণের উদ্ভিদ। একসময়  সেসব উদ্ভিদ থেকে আস্তে আস্তে জঙ্গলে পরিণত হতো। এসব জঙ্গলের সাথে জন্মে থাকে কাঁঠালি বটগাছ, জিরা বটগাছ। 

বটগাছের কোনও বীজ রোপণ করা যায় না। আর বটের বীজ রোপণ করলে বীজ থেকে গাছ জন্মায়ও না। তাহলে পুরানো দেয়াল, আর পুরানো দালান-কোঠা, পুরানো প্রাচীরে বটগাছ জন্মালো কীভাবে? 

যেভাবে বটগাছ জন্মায়:
বসন্ত ও শরৎকালে বটগাছে নতুন পাতা গজানোর সময় হয়। একসময় বটগাছের ঢালার মঞ্জরিতে ফুলের কলি বের হতে থাকে। ফুল ফোটে। মঞ্জরির গর্ভে ফুলগুলো লুকানো থাকে৷ ফুলগুলো খুবই ছোট এবং ফলের মতোই গোলাকার৷ ফলগুলো হুবহু আঙুরফলের মতো। দেখতে লাল রঙের। 

এই ফলগুলো পাখিরা মহানন্দে ফল খেয়ে ওদের পেটের ক্ষুধা নিবারণ করে। একসময় পাখিরা  মলত্যাগ করে এই বীজ ছড়িয়ে দেয়৷ পাখিবাহিত এই বীজ দালানের কার্নিশ, পুরানো দালানের ফাটল ও অন্য কোন গাছের কোটরে জমা থাকে। 

সেই বীজ থেকে আস্তে আস্তে গাছ জন্মাতে থাকে ৷ একারণে উপগাছা বা পরগাছা হিসেবেও বটগাছের বেশ খ্যাতিও আছে৷ এই বটগাছ এমনই একটা গাছ, তার ফল হইতে বীজ সংগ্রহ করে বপন করলে গাছ জন্মায় না৷ আবার কোন দালানের কার্নিশ হইতে তৈরি গাছ উঠিয়ে এনে রোপণ করলে হয়৷ 

উপযুক্ত পরিবেশে একটি গাছ পাঁচ(৫)থেকে ছয়(৬)শত বছর বেঁচে থাকতে পারে৷ বট বাংলা অঞ্চলের আধিমতম বৃক্ষ৷ অনেক হিন্দু ধর্মাবলম্বী বটগাছকে দেববৃক্ষও বলে।

বটের বর্ণনা:
বটের পাতা একান্ত, ডিম্বাকৃতি, মসৃণ ও উজ্জল সবুজ৷ কচি পাতা তামাটে৷ স্থান-কাল পাত্রভেদে পাতার আয়তনের বিভিন্নতা একাধারে বটের বৈশিষ্ট্য তথা প্রজাতি শনাক্তকরণের পক্ষে জটিলতার কারনও৷ 

পরিণত গাছের পাতা আকারে কিছুটা ছোট হয়ে আসে৷ বটের কুঁড়ি পাংশুটে হলুদ এবং এর দুটি স্বল্পায়ু উপপত্র পাতা গজানোর পরই ঝরে পড়ে৷ খুব অল্প বয়স থেকেই বট গাছের ঝুরি বা লত নামতে শুরু করে৷

তবে কাঁঠালি বটের ঝুরি বা লত বেশি নামে। এসব ঝুরি বা লত মাটির সংস্পর্শ পেলেই বাড়তে থাকে। ডালপালার ঝুরিগুলো একসময় মাটিতে গেঁথে গিয়ে নিজেরাই একেকটা কান্ডে পরিণত হয়৷ 

এভাবেই বট গাছ ধীরে ধীরে চারপাশে বাড়তে থাকে এবং একসময় মহীরুহে পরিণত হয়৷ তখন সর্বপ্রথম জন্মানো গাছটিকে আর চানে যায় না। সবই ঝুরি বা লত গাছের মতনই দেখা যায়।

বট গাছকে ঘিরে বাংলা অঞ্চলে রয়েছে শত সহস্র বছরের ইতিহাস ঐতিহ্য৷ (আর এই ঐতিহ্য বহনকারী একটি বট গাছ রয়েছে আমাদের বাংলাদেশেও৷

জানা যায়, ঝিনাইদহের কালিগঞ্জ উপজেলার মল্লিকপুর গ্রামে৷ এ বট গাছের যে বিশাল ব্যাপ্তি তা ডিজিটাল যুগের উন্নত ক্যামেরার ফ্রেমে ধরা সম্ভব নয়৷ এই গাছটা আঠার(১৮) বাঘা জমির উপর বিস্তৃত৷

বনবিভাগের উদ্যোগে এর চারপাশ বাঁশ-মূলি দিয়ে ঘেরা হয়েছে গাছটি সুরক্ষিত রাখার জন্য৷ এই বটগাছটার জন্ম কথা জানে এমন লোক বর্তমানকালে কালিগঞ্জ উপজেলায় নেই৷ যাকেই জিজ্ঞাসা করা হয়,সে-ই বলে, "আমার দাদাও বলতে পারেনা,আর আমি বলবো কীভাবে?" 

জানা যায় এই গাছ হলো বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বটগাছ৷ উষ্ণ আবহাওয়ায় বিশাল আয়তনের এই ছায়াবৃক্ষটি মানুষের অনেক উপকারে আসে৷ প্রাচীনকাল থেকেই বটবৃক্ষের ছায়ায় হাট-বাজার বসে, মেলা হয়, লোকগানের আসর বসে। জনসভারও আয়োজন হতো৷

এর কারণ হিসেবে বলা যায়, আগেকার সময়ে বাংলার গ্রামাঞ্চলে বড় বড় সুশীতল হলরুম ছিল না৷ আর তাই বড় বড় অনুষ্ঠান ও জনসভাগুলো ছায়াসুনিবিড় বটতলায় অনুষ্ঠিত হতো৷ এখনো গ্রামাঞ্চলে সেই দৃশ্য অনেকসময় চোখে পড়ে৷  বটগাছকে ভারত ও বাংলাদেশের সনাতন ধর্মাবলম্বী লোকেরা শিবের (মহাদেব) ছায়াবৃক্ষ হিসেবে মান্য করে থাকে৷

যার কারণে এই বটগাছ ভারত ও বাংলাদেশের হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষেরা কাটেও না,বটগাছের লাকড়ি পোড়ায়ও না৷ এখনো হিন্দু ঘনবসতি এলাকায় এই বটগাছের নিকটে মন্দির স্থাপন করে পূজা অর্চনা দিতে দেখা যায়৷ আর বটগাছের নিচে শিবের (মহাদেব) হাতের একটা অস্ত্র(ত্রিশুল) গাড়া থাকতে দেখা যায়। যার কারণে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলসহ দক্ষিণ এসিয়ার কয়েকটি দেশে ধর্মীয় কারণে বটগাছ কাটা নিষিদ্ধ৷ 

এখন আসা যাক লেখার মূল বিষয় নিয়ে।
লেখার মূল বিষয় হলেই, ❝একটা সমাধিস্থল ও একটা বটগাছ। ❞
 
ছবিটি পাগলা সাধুর সমাধিস্থল মঠকে ঘিরে রাখা একটা বটগাছের। 
সেই বটগাছ আর সমাধিস্থল হলো, নারায়নগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন গোদনাইল এলাকায়। এই বটগাছটির অবস্থান চিত্তরঞ্জন কটন মিলের পুকুর পাড়ে। বটগাছটি একটি সমাধিস্থানকে অতি আদরে ঘিরে রেখেছে৷ সমাধিস্থানটি হলো একটি মঠ,(মন্দিরের মত) সমাধিস্থান৷ 

আগেকার সময় কোন সরকারি বা পৌরসভার অধীনে হিন্দুদের জন্য খুব কম সংখ্যক শ্মশানঘাট ছিল। যা চোখে না পড়ার মতো৷ কাজেই কোন হিন্দু লোক মৃত্যুবরণ করলে তার শবদাহ বা (অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া) করা হতো তার নিজস্ব জায়গাতে। যার জায়গার অভাব ছিলো, তার মরদেহ দাহ (অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া) করা হতো, কোনওএক জলাশয়ের ধারে, না-হয় নদীর পাড়ে৷ 

১৯৪০ সালের দিকে পাগলা সাধু নামে একজন সাধু ছিলো। তাদের নিজস্ব বাড়ি ছিল নারায়ণগঞ্জ সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন গোদনাইল এলাকায়। বর্তমান চিত্তরঞ্জন কটন মিলস্ পুকুরপাড় সংলগ্ন। এই পাগলা সাধুর মরদেহ বসত বাড়ির পাশে চিত্তরঞ্জন পুকুরপাড় দাহ করা হয়। এরপর তার পুত্র মধু ঘোষ জন্মদাতা পিতার সমাধিতে একটি মঠ নির্মাণ করে রাখে। 

একসময় তারা সপরিবারে হিন্দু মুসলিল রায়টের সময় ঘর-বাড়ি ছেড়ে ভারত চলে যায়৷ রায়টের পর তাদের স্ব-সম্পত্তি কিছু বিক্রি হয়, কিছু হয়ে যায় বেদখল। কিছু  বেদখল হয়ে যায় ঠিকই, কিন্তু পাগলা সাধুর সমাধির মট খানা সেভাবেই থেকে যায়৷ আর সেই মঠ হতে একটি বটগাছ জন্মে বড় হতে থাকে।

বর্তমানে মঠ থেকে গজে ওঠা বটগাছটি মঠটাকে এমন ভাবে জরিয়ে রেখেছে, এখন আর মঠ(মন্দির) দেখা যায় না৷ শুধু বট গাছের শিখর আর শিখর৷ দূর থেকে কেউ বুঝবেও না যে, এখানে একটি মঠ(মন্দির) আছে৷ 

আগে এখানে অনেকেই সকাল-সন্ধ্যা প্রদীপ জ্বালাত। দিতো সকাল-সন্ধ্যা  ধূপের ধোঁয়া। বর্তমানে এখানে আর কেউ সকাল-সন্ধ্যা ধূপের ধোঁয়া আর মোমবাতি জ্বালায় না। হয় না কোনও  বাৎসরিক মেলা বা কোন হরিনাম সংকীর্তন। 

অনেকের মুখে শুনা যায় যে, আগে এই মঠ বা মন্দিরে মনবাসনা পূর্ণের আশায় এখানে অনেকেই মানত/নিয়ত বাঁধত৷ শোনা যায় নিয়ত বা মনের আশা পূর্ণও হয়েছে অনেকের। সমাধিস্থান মঠ থেকে গজে ওঠা বটগাছটি দেখে বুঝা যায় যে, পাগলা সাধুর সব জায়গা বেদখল হলেও এই মঠ বেদখল হতে দিবো না।

এই পবিত্র সমাধিস্থানের মঠটির বটগাছের শিকড়ের ভেতরে আছে বিশালাকার দু'টি সাপ। এই সাপ দু'টি সময় সময় অনেকের চোখে পড়ে। কিন্তু কাউকে ক্ষতি করে না। এতে ধরে নেওয়া যায় যে, সাপ দুটো পাগলা সাধুর পবিত্র সমাধিস্থানের মঠটির পাহারাদার। তাই দিনেরবেলায়ও সমাধিস্থান মঠের সামনে গেলে কেমন যেন শরীরে কাঁপন ধরে। 

মঠের সামনে গেলে সবচেয়ে অবাক লাগে মঠটিকে আদর করে আঁকড়ে ধরে রাখা বটগাছটি দেখলে। যেন মায়ের আঁচল দিয়ে মঠটিকে ঢেকে রেখেছে। এখন আর কেউ মঠের একটা ইটও খুলে নিতে পারবে না। প্রতিটি ইটের ভেতরে ভেতরে বটের শিকড় পেছানো আছে। 

তাই অনেকে বলে, “এই বটগাছটির জন্যই পাগলা সাধুর সমাধিস্থানের মঠটি রক্ষা পেলো। বটগাছটি না থাকলে তাদের ফেলে যাওয়া জায়গা সম্পত্তির সাথে এই সমাধিস্থানের মঠটিরও অস্তিত্ব হারাতে হতো।" 
জয়তু পাগলা সাধু, জয়তু বটগাছ। 
 

প্রিয় পাঠক, লেখা পড়ে ভালো লাগলে দয়াপূর্বক লাইক/কমেন্ট ও শেয়ার করে বাধিত করবেন। 

ব্লগ ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, 
২৪/০৫/২০২৩ইং।

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

nitaibabunitaibabu@gmail.com

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আমার শৈশবের বন্ধু— শীতলক্ষ্যা

একটি মাঠ; হাজারো প্রাণের স্মৃতি

মা নাই যার, সংসার অরণ্য তার