ডিসএন্টেনা আর ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটর কারণে কি বিটিভি সহ দেশীয় চলচ্চিত্র একদিন ধ্বংস হয়ে যাবে?
কোনোএক সময়ের সাদাকালো টেলিভিশনের হুলুস্থুল শেষ হয়ে শুরু হয়েছিল কালার টেলিভিশনের সু-সময়। সাথে ডিসএন্টেনা সংযোগ। তারপর ওয়াইফাই নামের ইন্টারনেট সংযোগে দেখা মেলে। ওয়াইফাই নামের ইন্টারনেট সংযোগের মাধমে চলে বিশাল পর্দার স্মার্ট অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম টেলিভিশন। তাই বর্তমানে দেখা যায় দেশের আনাচে-কানাচে, ঘরে-বাইরে, হাট-বাজারে এসব টেলিভিশনের ছড়াছড়ি। এমনকি রাস্তার পাশে থাকা বস্তির ঝুপড়ি ঘরেও চলছে আগেকার বাক্স মার্কা কালার টেলিভিশনের পাশাপাশি স্মার্ট টেলিভিশন। এসব টেলিভিশনের সামনে বসে ছেলে বুড়ো সবাই মনের আনন্দে রঙিন পর্দায় প্রদর্শিত কত কী উপভোগ করছে।
মহল্লার গলিতে থাকা প্রতিটি মুদি দোকান, চা’র দোকানেও থাকছে টেলিভিশন নামের এই জাদুর বাক্সটা। চা পান করছে, সিগারেট ফুঁকছে, আর চোখ রাখছে টেলিভিশনের দিকে। এদের মাঝে থাকা বুড়ো বয়সের কাউকে যদি জিজ্ঞেস করি, “কেমন চলছে বর্তমান স্যাটেলাইট যুগে আমাদের দেশীয় নাটক,সিনেমা, বিটিভি’র গরম নরম খবর?«
এককথায় উত্তর আসে, “না, ওইসব বেশি ভালো না! ওইসব আর এখন দেখতে ভালো লাগে না। দেশীয় টিভি চ্যানেলেও আগের মতো নাটক, পুরানো দিনের ছায়াছবি দেখানো হয় না। যদিও কোনও চ্যানেলে দেশীয় ছায়াছবি প্রদর্শিত হয়, তবুও এ-যুগের ছেলে-পেলেরা সেসব ছায়াছবি মোটেও দেখে না। আর বিটিভি তো কেবল রাষ্ট্রীয় যাদুর বাক্সের মতো সাজিয়ে রেখেছে।”
কথাগুলো কিন্তু বাস্তব সত্যি কথা। বর্তমানে শহরে বসবাসকারী কেউ সিনেমাহলে তো যায়-ই-না, বিটিভি বা অন্যান্য দেশি চ্যানেলের দেশীয় নাটকগুলোও কেউ দেখে না। দেখে হিন্দি ছায়াছবি। তামিল এ্যাকশন ছবি। রেসলিং মারামারি। স্টার জলসার ধোঁকাবাজি নাটক। আর স্মার্ট টেলিভিশনে ওয়াই-ফাই সংযোগে তো বিশ্ববিখ্যাত সার্চ ইঞ্জিন গুগলের ইউটিউব থাকছেই। এসব নিয়েই বর্তমান সময়ের প্রায় লোকেই ওইসব নিয়েই মজে থাকে। তাই ৬০-৭০ বয়সের অনেক বুড়ো-বুড়িরা আফসোসের সাথে এসব কথাগুলো বলে থাকে!
আমি যেই এলাকায় বসবাস করি, সেই এলাকার একটা ছোট বাজারের একপাশে আমার কর্মস্থল। সামনে একসাথে তিন-চারটে চা’র দোকান। প্রতিটি দোকানেই টেলিভিশন নামের যাদুর বাক্সটা সেট করা আছে। তা-ও আবার কালার টেলিভিশন। কোনো-কোনো দেকানে স্মার্ট টেলিভিশনও আছে। এসব দোকানগুলোতে সকাল থেকে রাত দু’টা পর্যন্তও কাস্টমারের ভিড় থাকে। সকাল থেকে রাতদুপুর পর্যন্ত ভিড় থাকে বিশেষ করে টেলিভিশন দেখার জন্যই। টেলিভিশনে চলতে থাকে ভিনদেশি চ্যানেলের বিভিন্ন অনুষ্ঠান। কিন্তু বাংলাদেশ টেলিভিশন “বিটিভি” নামের রাষ্ট্রীয় বাক্সটা কেউ ভুলেও চুপি দিয়ে দেখে না। এমনকি রিমোট কন্ট্রোলের কত নম্বর বাটনে চাপ দিলে বিটিভি চ্যানেল আসবে, দোকানদার তাও জানে না।
শুধু একজন দোকানদারই বা কেন? যাদের বাসা-বাড়িতে টেলিভিশন নামের এই যাদুর বাক্সটা আছে, তারাও কেউ বিটিভি, আর বিটিভি ওয়ার্ল্ড চ্যানেলটি দেখে না! জানেও না রিমোট কন্ট্রোলের কত নম্বর বাটনে বিটিভি চ্যানেল। তা দেখে মনে হয় আকাশ প্রযুক্তি ডিসএন্টেনা আর ব্রডব্যান্ড ওয়াই-ফাই ইন্টারনেটের কারণে চিরতরে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের রাষ্ট্রীয় চ্যানেল বিটিভি। এর সাথে সাথে জনপ্রিয়তা হারাচ্ছে দেশীয় সব টিভি চ্যানেল।
এসব দেখে আগেকার সময়ের কথা মনে পড়ে যায়। যে-সময়টা ছিল বিটিভি’র জয়জয়কার সময়। সে-সময়ের কথা ভাবতে গেলে নিজের কিছু স্মৃতিকথা এখানে শেয়ার করতে হয়!
উপরের ছবিটি হলো একটি জনবহুল মহল্লা। মহল্লায় থাকা একটা চা’র দোকানে চলছে কালার টেলিভিশন। দেখছে ভারতীয় ছায়াছবি। বাংলাদেশী চ্যানেলের কিছুই দেখে না।
আমার জন্ম ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসের মাঝামাঝি সময়ে। আর সাদাকালো টেলিভিশন আবিষ্কার হয়, ১৯২৬ খ্রিস্টাব্দে। আমাদের দেশে টেলিভিশন আসে ১৯৬৪ খ্রিস্টাব্দে। তাও তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের আমলে। নাম ছিল ইস্ট পাকিস্তান টেলিভিশন। তার মানে এই বঙ্গদেশে টেলিভিশন আসার বছরখানেক আগেই আমার জন্ম হয়েছিল। একটু বোঝার বয়স হতেই টেলিভিশন দেখা শুরু করেছি। সেই দেখা শুরু হয়েছিল, স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে। তখন আমরা সপরিবারে থাকতাম, নারায়ণগঞ্জ বন্দর থানাধীন লক্ষ্মণখোলা গ্রাম সংলগ্ন আদর্শ কটন মিলে।
তখন কিন্তু এদেশের অনেকেই রঙিন টেলিভিশন চোখেও দেখেনি। এই বঙ্গদেশে রঙিন টেলিভিশনের আগমন ঘটে, ১৯৮০ খ্রিস্টাব্দের মাঝামাঝি সময়ে। সেসময় ওয়াই-ফাই তো দূরের কথা, ডিসএন্টেনাও ছিল না। ডিসএন্টেনা কাকে বলে, তাও কেউ জানত না। সাদাকালো টেলিভিশনের পর্দায় যা দেখতাম, তা শুধু বাংলাদেশ টেলিভিশন নামের বিটিভি থেকে সম্প্রচার হওয়া অনুষ্ঠানগুলোই।
আদর্শ কটন মিলের ভেতরে টেলিভিশন ছিল না। বন্দর থানাধীন লক্ষ্মণখোলা এলাকায় জনতা ক্লাবে একটা সাদাকালো টেলিভিশন ছিল। আর একটা ছিল, শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিমপাড় চিত্তরঞ্জন কটন মিলের শ্রমিক কর্মচারীদের ক্লাবে। মানুষের ভিড়ে লক্ষ্মণখোলা জনতা ক্লাবে দেখার সুযোগ না হলে, চলে আসতাম শীতলক্ষ্যা নদীর পশ্চিমপাড় চিত্তরঞ্জন কটন মিলের ক্লাবে। তখন এদেশে বড়বড় নেতাদের ক্যাডার নামের কোনও অস্তিত্ব ছিল না। ছিল মাস্তান বা রুস্তমের রাজত্ব।
উপরের ছবিটিও একটি জনবহুল মহল্লার চা’র দোকান। দোকানে বসে কালার টেলিভিশনে দেখছে ভীনদেশী ছায়াছবি। বিটিভি’র গন্ধও নেই!
যেসব রুস্তমরা একটু বেশি বাহাদুরি দেখাতো, তাদের বলতো পাইন্না রুস্তম। ওইসব রুস্তমদের গলায় বাঁধা থাকতো একটা রুমাল। অনেক রুস্তমদের হাতেও রুমাল বাঁধা থাকত। তারা থাকতো বড়বড় সরদারদের অনুগত। মানে সরদারদের চামচা। আর সরদার মানে ডাকাত সরদার, মিলের লাইন সরদার, চোরের সরদার, হাট-বাজারের সরদার। বর্তমানে যাদের বলা হয় নেতা। প্রত্যেক এলাকায় ওইসব সরদারদের গৃহপালিত পশুর মতো রুস্তম বা পাইন্না রুস্তম থাকতো। ওইসব রুস্তমদের জ্বালায় ঠিকমত টেলিভিশন দেখতে পারতাম না। কারণ প্রতিটি ক্লাবেই ক্রামবোর্ড থাকতো। বেশিরভাগ সময়ই রুস্তমরা ক্লাবের মাঝখানে ক্রামবোর্ড খেলায় ব্যস্ত থাকতো। রুস্তমদের রুস্তমিতে আর ঠিকমত টেলিভিশন দেখা হতো না।
আবার রুস্তমদের একটু ডিস্টার্ব হলে, গালি-গালাজ-সহ মারধরও করতো। সেই সময়ে টেলিভিশন দেখতে গিয়ে রুস্তমদের হাতে অনেক মার খেয়েছি। তবু বিটিভির অনুষ্ঠান দেখেছি। বিটিভি ছাড়া তখন অন্যকোনো চ্যানেল ছিল না। আর অন্যকোনো চ্যানেলের ব্যাপারে কারোর কোনও ধারনাও ছিল না।
একবার সারা দেশে জিকির উঠেছিল যে টেলিভিশন এন্টেনারের সাথে সিলভারের বাটি, না হয় সিলভারের সরা লাগালে নাকি ভারতের অনুষ্ঠান দেখা যায়! সেই জিকিরে ঢাকা-সহ সারাদেশে একযোগে শুরু হয়েছিল, টিভি এন্টেনার সাথে সরা আর সিলভারের বাটি লাগানোর মহোৎসব।
সিলভারের বাটি আর সরা লাগিয়ে দর্শক তখন কিছুদিন ভারতীয় রাষ্ট্রীয় দূরদর্শন কোনরকম দেখতে পেরেছিল। তারপরও কিন্তু বিটিভি’ই ছিল মানুষের একমাত্র দেখার চ্যানেল, নিজেদের চ্যানেল, আনন্দের চ্যানেল। বিকাল ৫টায় পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতের মধ্যদিয়ে শুরু হতো বিটিভির অনুষ্ঠানমালা। শেষ হতো রাত ১১টায় বাংলা সংবাদ শিরোনামের পর। কোনোদিন রাত ১১টায় বাংলা ইংরেজি শিরোনাম সংবাদের শেষ পর্যন্তও বসে থাকতাম টেলিভিশনের পর্দার দিকে চোখ রেখে। ভাবতাম খবরের পর হয়তো আরও কিছু দেখাবে। কিন্তু না, বাংলা ইংরেজি সংবাদ শিরোনাম শেষ হবার পরই টেলিভিশন চালক, টেলিভিশনের সুইচ অফ করে দিতো। মন খারাপ করে বাসায় চলে আসতে হতো।
বাসায় আসলে হতো আরেক বিপদ। বড়দা, নাহয় বাবার হাতে খেতে হতো মার। নাহয় থাকতে হতো না খেয়ে। টেলিভিশন দেখতাম মনের সুখে, বাসায় এসে মরতাম মার খেয়ে, নাহয় মরতাম ক্ষুধার জ্বালায়। তবু টেলিভিশনে বিটিভির অনুষ্ঠান দেখতাম। আগের দিনের মার খাওয়ার কথা ভুলে গিয়ে, পরদিন আবার মনের আনন্দে টেলিভিশনের সামনে গিয়ে বসতাম। তখন সপ্তাহের সাতদিনই রাত ৮টার বাংলা সংবাদের পর একটা করে ইংরেজি ছায়াছবি থাকতোই। আরও থাকতো প্রতিমাসে একদিন পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা ছায়াছবি। থাকতো বাংলা নাটক, নৃত্যানুষ্ঠান, সাপ্তাহিক সিরিজ বাংলা নাটকের পর্ব।
ইংরেজি ছায়াছবিগুলো সম্প্রচার করা হতো একঘন্টা করে। একেকটা ইংরেজি সিরিয়াল একবছর দেড়বছর সময় ধরেও চলতো। যেমন ছিল, হাওয়াই ফাইভও, সিক্স মিলিয়ন ডলার ম্যান, বায়োনিক ওম্যান, speech 1999-সহ আরও কিছু ইংরেজি ছায়াছবি। লেখাপড়া গোল্লায় গেলেও ইংরেজি সিরিজগুলো নিয়মিতই দেখতে হতো।
এলাকায় থাকা একটা অফিসে ওয়াইফাই সংযোগের মাধ্যমে ইউটিউব থেকে ওয়াজ শুনছে।
আর বাংলা সাপ্তাহিক ধারাবাহিক নাটকগুলো একেকদিন একেকটা করে দেখানো হতো। তা প্রতি সপ্তাহের প্রতিদিন। ওইসব ধারাবাহিক নাটকগুলোও ছিল মনমাতানো। সে সময় অনেক ধারাবাহিক নাটকই প্রচুর জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। যেমন ‘সকাল সন্ধ্যা’, ‘ভাঙনের শব্দ শুনি’, ‘আমি তুমি সে’ ইত্যাদি। এরপর ৯০ দশকের দিকে আসে সংশপ্তক, কোথাও কেউ নেই। তাও ছিল জনপ্রিয় নাটক। আরও অনেক নাটক ছিল, সেগুলোর নাম আর এখন মনে পড়ছে না।
সে-সময় প্রতিদিন চেষ্টা করতাম, রাত ৮টার আগেই টেলিভিশনের সামনে থাকতে। কোনরকম লেখাপড়া শেষ করেই, টেলিভিশনের সামনে ওঁত পেতে বসে থাকতাম। টেলিভিশন দেখার জন্য ওঁত পেতে শুধু আমিই থাকতাম না, থাকতো সেই সময়ের আমার মতো টেলিভিশন পাগল আরও অনেকেই। এখন আর ওইরকম টেলিভিশন পাগল দেখা যায় না। দেখা যায় ভারতীয় স্টার জলসা, জি-সিনেমা-সহ বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন চ্যানেল ও ছবি দেখার পাগল। এছাড়াও বর্তমানে ছেলে-বুড়ো সবার হাতে তো অ্যান্ড্রয়েড অপারেটিং সিস্টেম টাচস্ক্রীন মোবাইল আছেই।
সেই সময় মানুষের ভিড়ে অনেকসময় টেলিভিশনের সামনে জায়গা পেতাম না। জায়গা হতো দূরে, আর না হয় গাছের ডালে। টেলিভিশন দূর থেকে বেশি ভালো দেখা যায় না। তাই সবসময় টেলিভিশনের সামনেই বসার জায়গা রাখার চেষ্টায় বেশি থাকতাম। তখনকার দিনে টেলিভিশন আর বিটিভি যে মানুষের কাছে কত স্বাদের বিনোদন ছিল, তা আর লিখে বোঝানো যাবে না। মানুষ ক্লাবের সামনে গাছের উপরে বসেও বিটিভির অনুষ্ঠানমালা উপভোগ করতো।
একদিন টেলিভিশন দেখতে গিয়ে আমাদের সমবয়সীদের সাথে লেগে যায় হট্টগোল। সেই গোলযোগের সূত্র ধরেই আদর্শ কটন মিলে আসে শ্রমিক কর্মচারীদের জন্য ১৭ ইঞ্চি সাদা-কালো টেলিভিশন। সেই থেকে কাউকে আর মিলের বাইরে গিয়ে টেলিভিশন দেখতে হতো না। মিলের শ্রমিক কর্মচারী ও তাদের পরিবারের সদস্যরা মিলের ভেতরেই টেলিভিশন দেখতো। তখনকার সময়ে বাংলা ছায়াছবি সিনেমাহলে মুক্তি পাবার আগে রেডিওতে সেই ছায়াছবির কিছু গান, কিছু সংলাপ প্রচার করা হতো। তা দেখে সিনেমা পাগলরা সিনেমাহলে গিয়ে ভিড় জমাতো।
তখনকার সময়ে পুরো নারায়ণগঞ্জ শহরে ছয়টি সিনেমাহল ছিল। প্রত্যেকটি সিনেমাহলেই প্রতিদিন প্রতিটি শো-তেই হাউসফুল দর্শক হতো। সিনেমাহল মালিকদের তখন ছিল রমরমা ব্যবসা। সেই ব্যবসা কেড়ে নিয়েছে বর্তমান যুগের আকাশ প্রযুক্তি ডিসএন্টেনার ভারতীয় চ্যানেলগুলো আর ওয়াইফাই নামের ইন্টারনেট ভিত্তিক ইউটিউব। সাথে কেড়ে নিয়েছে এদেশের চলচ্চিত্রের সাথে জড়িত থাকা সবার কিসমত। কেড়ে নিয়েছে দেশের বিনোদন প্রেমীদের মনমানসিকতা। সাথে ধ্বংস আর বিলুপ্তি হতে লাগলো দেশের সিনেমাহল গুলো।
তাই এখন আর ওইরকম বিটিভি পাগল নেই। সিনেমা পাগলও নেই! ঘরে ঘরে আছে ভারতীয় স্টার জলসা, জি-সিনেমা-সহ বিভিন্ন দেশের চ্যানেলের ছবি দেখার পাগল। বর্তমান ডিজিটাল যুগের বিটিভি ও আকাশ প্রযুক্তি ডিসএন্টেনার সংযোগ সবার ঘরে ঘরে। এর সাথে যুক্ত হয়েছে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ ওয়াই-ফাই। যা দিয়ে বিশাল পর্দার এলসিডি এন্ড্রোয়েড টেলিভিশনে বিশ্ববিখ্যাত সার্চ ইঞ্জিন গুগলের ইউটিউব-সহ বিভিন্ন ওয়েবসাইটে থাকা ছায়াছবি, নাচ-গান দেখা যায়, উপভোগ করা যায়।
তাই শহরের রাস্তার ধারে, মহল্লার অলিতে-গলিতে থাকা বিদ্যুতের খাম্বায়, টেলিফোনের তার খাম্বায় কেবল সংযোগের জট মানুষের নজরও কাড়ে। এসব ডিসএন্টেনা ব্যবসায়ীরা গ্রাহকদের কার আগে কে সংযোগ দিবে এই নিয়ে একসময় খুবই ব্যস্ত থাকতো। সময়-সময় এসব ডিসএন্টেনার সংযোগ দেওয়া নেওয়া নিয়ে ব্যবসায়ীদের মধ্যে হানাহানি হতেও দেখা যেতো। তবে এখন আর তা হয় না। এখন ডিসএন্টেনা আর ওয়াইফাই ব্যবসায়ীদের যার যার মহল্লাভিত্তিক একটা নির্ধারিত সীমানা নির্ধারণ করা আছে। যার যার নির্ধারিত সীমানায় গ্রাহকদের ডিসএন্টেনা আর ওয়াইফাই সংযোগ দিচ্ছে, আর মাসে মাসে শ্লিপ কেটে বিল নিচ্ছে।
গ্রাহকও এই আকাশ প্রযুক্তির ডিসএন্টেনা আর ইন্টারনেট সংযোগে আজ ঘরে বসেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অর্ধশত চ্যানেলে অনুষ্ঠান দেখছে। ওয়াইফাই সংযোগে ফেসবুক, টুইটার-সহ বিশ্বের যে কোনো সামাজিক যোগাযোগ সাইটে যেতে পারছে, দেখতেও পারছে। তাই আমাদের দেশের মানুষ দেশীয় ছায়াছবি, নাটক বিটিভি’র সব অনুষ্ঠান দিনদিন বর্জন করে চলছে। এমনকি মানুষ এখন রাষ্ট্রীয় বিটিভি-সহ দেশীয় কোনও টিভি চ্যানেলে সম্প্রচার হওয়া কোনও জরুরি সংবাদ টুকুও টেলিভিশনে শুনে না, দেখেও না। এসবের কারণ শুধু একটাই, প্রথমত আকাশ প্রযুক্তি ডিএন্টেনা। দ্বিতীয়ত এই যুগের ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ওয়াইফাই সংযোগ।
তাই মনে হয় আমাদের দেশের চলচ্চিত্রের সাথে জড়িত থাকা অভিনেতা, অভিনেত্রীদের প্রতিবেশী দেশ ভারতীয় চলচ্চিত্র নির্মাতাদের কাছে ধর্না দিতে হচ্ছে এবং তাদের হুকুম মেনে অভিনয় করে জীবিকা নির্বাহ করতে হচ্ছে। এছাড়া তারা আর কোনও উপায় খুঁজে পাচ্ছে না বলেই মনে হয়।
বর্তমানে বিটিভি-সহ চলচ্চিত্র এবং সিনেমাহল গুলোর এরকম দৈন্যদশা চলার পরও সরকার এসবের দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। সরকার শুধু জোর দিচ্ছে সিনেমার মান উন্নয়নের দিকে। সরকারের এমন তাগিদে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উন্নয়ন সংস্থাও আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে ভালো মানের ছায়াছবি নির্মাণ করার জন্য। বর্তমানে অনেক ভালো মানের ছায়াছবি নির্মাণও করছে! তবুও আগের মতো দেশের মানুষকে সিনেমা হলমুখী করতে পারছে না।
পারছে না শুধু বর্তমান যুগের আকাশ প্রযুক্তি ডিসএন্টেনা আর ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের কারণে। তাহলে কি একদিন পাকিস্তানের চলচ্চিত্রের মতো আমাদের দুর্দশা বরণ করতে হবে? যাতে এমনটা নাহয়, তার আগেই সরকারকে এবিষয়ে সময় থাকতেই ভেবে দেখা দরকার বলে অনেকেই মনে করেন। সময় থাকতে যদি সরকার এবিষয়ে ভেবে না দেখে, তাহলে আকাশ প্রযুক্তি ডিসএন্টেনা আর ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের কারণে একদিন আমাদের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশন-সহ দেশীয় চলচ্চিত্র ধ্বংস হয়ে যাবে!
বি:দ্র: লেখাটা এর আগে শব্দনীড় ব্লগে শেয়ার করেছিলাম।
প্রিয় পাঠক, লেখা পড়ে ভালো লাগলে দয়াপূর্বক
লাইক/কমেন্ট ও শেয়ার করে বাধিত করবেন।
নাগরিক সাংবাদিক ও ব্লগার,
ব্লগ ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
০৭/০৫/২০২৩ইং।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
nitaibabunitaibabu@gmail.com