আদমজী জুট মিলস এর ইতিকথা ও বর্তমান আদমজী ইপিজেড

 আদমজী জুট মিলস বা আদমজী পাটকল। 

নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্যা নদী আর আদমজী জুট বা আদমজী পাট-কলের নাম শোনেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। কোনও একসময় শীতলক্ষ্যা নদীর স্বচ্ছ পানির যেমন সুনাম ছিল, আদমজী জুট মিলস বা আদমজী পাট-কলের তার চেয়েও বেশি সুনাম ছিল। 

কোনও একসময় এই শীতলক্ষ্যার স্বচ্ছ পানি ঔষধ তৈরির কাজে ব্যবহৃত হতো। আর আদমজী জুট মিলে তৈরি বিভিন্নরকম পাটজাত দ্রব্য রপ্তানি হতো সারা দুনিয়ায়।এটি ছিল এশিয়া মহাদেশের সর্ববৃহৎ জুট মিলস বা পাটকল। 

এই আদমজী জুট মিলস একসময় নারায়ণগঞ্জকে এনে দিয়েছিল প্রাচ্যের ডান্ডি উপাধি। আদমজী জুট মিলে ছিল প্রায় একলক্ষ লোকের কর্মসংস্থান। আদমজী জুটমিলে কর্মরত শ্রমিক ছিলো পাকিস্তানি অনেক মাড়োয়ারি। পাকিস্তানি মাড়োয়ারিদের পাশাপাশি বাঙালি শ্রমিকও ছিলো প্রায়ই সমানে-সমান। 

এসব মাড়োয়ারি শ্রমিকরা মিল অভ্যন্তরে সপরিবারে বসবাস করতো। স্বাধীনতা পরবর্তী সময় থেকে বর্তমানে অনেকেই তাদের পাকিস্তানি শরণার্থী বলে। বর্তমানে আদমজী জুট মিলস অভ্যন্তরে যেই জায়গায় মাড়োয়ারি শ্রমিকরা বসবাস করে, সেই জায়গার নাম শিমুলপাড়া বিহারি ক্যাম্প। 

আদমজী জুট মিলস প্রতিষ্ঠিত:
আদমজী পাটকল বা আদমজী জুট মিলস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলো ১৯৫১ খ্রিষ্টাব্দে। এটি ছিলো তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের দ্বিতীয় পাটকল বা জুট মিলস। প্রথম পাটকল বা জুট মিলস হলো, 'বাওয়া' পাটকল। এই পাটকল বা জুট মিলস-এর অবস্থান নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন এলাকায়।

এই পাটকল বা জুট মিলে পূর্ব পাকিস্তান (বর্তমানের বাংলাদেশ) এর উন্নতমানের পাট ব্যবহার করে বিভিন্ন পাটজাত দ্রব্য প্রস্তুত করা হতো। তাই সারাবিশ্ব এই নারায়নগঞ্জকে উপাধি দিয়েছিল 'প্রাচ্যের ড্যান্ডি'। সেই থেকে এই নারায়নগঞ্জ সারাবিশ্বে প্রাচ্যের ড্যান্ডি নামে পরিচিতি লাভ করে। 

আদমজী পাটকল বা জুট মিলের প্রতিষ্ঠাতা কে?:
আদমজী জুট মিলস বা আদমজী পাট-কলের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন, তদানীন্তন পাকিস্তানের অন্যতম ধনাঢ্য আদমজী পরিবারের তিন ভাই। তারা হলেন,  ওয়াহেদ আদমজী, জাকারিয়া আদমজী ও গুল মোহাম্মদ আদমজী। আদমজী পরিবারের এই তিন ভাই ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দে যৌথভাবে নারায়াণগঞ্জের শীতলক্ষ্যার পশ্চিমপাড় সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকায় ২৯৭ একর জমির উপর আদমজী জুটমিল বা আদমজী পাটকল পড়ে তোলেন। 

যেসব মেশিনারি দিয়ে আদমজী জুট মিলস বা আদমজী পাটকলের উৎপাদন শুরু হয়:
আদমজী মিলের উৎপাদন শুরু হয়, ১৯৫১ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে। আদমজী জুট মিলস বা আদমজী পাটকলে ছিলো, ১৭০০ হেসিয়ান ও ১০০০ সেকিং (তাঁত মেশিন) পাওয়ালুম। সাথে ছিলো পাট থেকে পাটের সুতা তৈরি করার আরও অনেকরকম মেশিনারি।

তখনকার সময়ের ওইসব উন্নতমানের মেশিনারি দিয়ে উৎপাদন হতো, চট, কার্পেটসহ বিভিন্ন প্রকার পাটজাত দব্য। এসব উৎপাদিত পাটজাত দ্রব্য দেশের চাহিদা পূরণ করে রপ্তানি হতো চীন, ভারত, কানাডা, আমেরিকা, থাইল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে। এভাবে একসময় আদমজী জুট মিল হয়ে ওঠে এশিয়া মহাদেশের মধ্যে  অন্যতম জুট মিল বা পাটকল।

আদমজী জুট মিলস বা আদমজী পাটকল হয়ে গেলো আদমজী ইপিজেড:
১৯৭০ এর দশকে প্লাস্টিক ও পলিথিন পাটতন্তুর বিকল্প হিসাবে আত্মপ্রকাশ করলে আদমজী পাট কলের স্বর্ণযুগের অবসান হয়। 
     আদমজী জুট মিলস থেকে আদমজী ইপিজেড। 

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে এটিকে জাতীয়করণ করা হয়। 

তখন থেকে ১৯৮০ এর দশকের কয়েকটি বছর ব্যতীত অন্য সব বছর এটি বিপুল পরিমাণে লোকসান দেয়। অব্যাহত লোকসানের কারণে প্রতিষ্ঠার ৫২ বছর পর ২০০২ খ্রিস্টাব্দের ২২ জুন এশিয়ার সর্ববৃহৎ কারখানাটি সরকার কর্তৃক বন্ধ করে দেয়া হয়।

বর্তমান আদমজী ইপিজেড:
একসময় এশিয়ার সর্ববৃহৎ পাটজাত দ্রব্যের কারখানাটির নাম হয়ে যায় আদমজী ইপিজেড। ২০০৬ সালের ৬ মার্চ এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। 

আদমজী ইপিজেডের যাত্রা শুরু হওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশি-বিদেশি বিনিয়োগে বহু শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। বর্তমানে এই আদমজী ইপিজেড-এ আগেকার আদমজী জুট মিলের মোট শ্রমিক সংখ্যা থেকেও অনেকগুণ বেশি। 

আদমজী ইপিজেডকে কেন্দ্র করে সিদ্ধিরগঞ্জ থানাধীন এলাকা ছেড়েও শীতলক্ষ্যা নদীর এপার-ওপার দুপারে বেড়ে গেছে জনবসতি। বেড়েছে ছোট-বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান।বেড়েছে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা বহু লোকের আবাস। পড়ে ওঠেছে অনেক দোকানপাট-সহ বড় বড় মার্কেট ও শপিংমল। তাই বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ সিদ্ধিরগঞ্জ এলাকা-সহ এর আশপাশে দিনরাত দেখা যায় লোকে লোকারণ্য!  জয় হোক আদমজী ইপিজেড-এর! 

প্রিয় পাঠক, লেখা পড়ে ভালো লাগলে দয়াপূর্বক লাইক/কমেন্ট ও শেয়ার করে বাধিত করবেন। 

নিতাই বাবু: ব্লগ ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম,
৩০/০৫/২০২৩ইং।

মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

nitaibabunitaibabu@gmail.com

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আমার শৈশবের বন্ধু— শীতলক্ষ্যা

একটি মাঠ; হাজারো প্রাণের স্মৃতি

মা নাই যার, সংসার অরণ্য তার