ফেসবুকে একটা লাইকের মূল্য কত?

              ফেসবুক লাইকের মূল্য কত?

ফেসবুক হলো বর্তমান বিশ্বে সামাজিক যোগাযোগ ব্যবস্থার একটি ওয়েবসাইট। নির্মাতা হলেন, মার্ক জাকারবার্গ। যার পথচলা শুরু হয় ২০০৪ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি থেকে।

শুরু থেকে অদ্যবধি ফেসবুক ব্যবহারকারী শুধু লাইক নিয়েই বেশি ব্যস্ত থাকে। যা এখন সারাবিশ্বে ফেসবুক ব্যবহারকারীদের মধ্যে অনেক ব্যবহারকারী লাইক ভিক্ষুক সেজেছে।

তা দেখে মনে হয় ফেসবুক নির্মাতা মার্ক জাকারবার্গ শুধু স্বাদের লাইক সিস্টেমটাকে কেন্দ্র করেই, ফেসবুক তৈরি করেছেন। কারণ, লাইক ছাড়া তো ফেসবুকের মজাই থাকে না, তাই।

আমি ফেসবুকে সদস্য হয়েছি ফেব্রুয়ারি ২০১২ সালের মাঝামাঝি সময়ে। তখন ফেসবুকের ধরণই ছিল ভিন্ন। তার মানে হলো সোজা সাপটা যাকে বলে! তখন ফেসবুকে হরেকরম লাইক ছিল না, গ্রুপও ছিল না।

ওইসময় সামাজিক যোগাযোগ সাইট ফেসবুকে দেশ-বিদেশের কবি, সাহিত্যিক, লেখক, লেখিকা, রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রী, মিনিস্টার, ডাক্তার, উকিক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ, নেতা, নেত্রীদের দেখা যেত না। একসময় তাঁরা ফেসবুকের সুনাম তো মুখে আনতেন-ই-না, বরং এর সমালোচনাই বেশি করতো।

আর এখন সব দেশের সব রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, কবি, সাহিত্যক, লেখক/ লেখিকা, সিনেমার নায়ক, নায়িকারাও দিন-রাত ২৪ ঘণ্টা ফেসবুকে যার যার পেইজ বা গ্রুপ নিয়ে ব্যস্ত থাকে, সবর থাকে, নজরও রাখে।

লেখকগণ লেখে। কবিগণ কবিতা লেখে। সাহিত্যিকরা সাহিত্য নিয়ে লেখে। তাঁরা পেইজ বা গ্রুপ তৈরি করে সেখানে অন্য লেখক/লেখিকাদের আমন্ত্রণ জানায়, “আসুন, এখানে লিখুন! আপনার আলোকিত প্রতিভা প্রচার করুন!”

ওইসব পেইজ বা গ্রুপে সদস্য হতে হলে আগে গ্রুপের পিন পোস্ট (শর্তাবলী) পড়তে হবে। তারপর গ্রুপের শর্ত মেনে নিয়ে গ্রুপে অ্যাক্টিভ হতে হবে।

ওইসব গ্রুপের শর্ত থাকে গ্রুপে অন্যদের পোস্টে পড়তে হবে, লাইক/ কমেন্ট করতে হবে। একজন সদস্য যদি কারোর পোস্টে লাইক/কমেন্ট না করে, তাহলে কয়েকদিন পর ঐ সদস্যকে গ্রুপ থেকে বহিষ্কার করা হয়।

আবার অনেক গ্রুপের একটা ভালো দিকও চোখে পড়ে। ওইসব পেইজ বা গ্রুপের অ্যাডমিনরা বা গ্রুপ পরিচালকগণ গ্রুপে অ্যাক্টিভ থাকা সদস্যদের নিয়ে বিভিন্নরকম আয়োজনেও করে থাকে। যেমন–পিকনিক, আড্ডা, সভা, সেমিনার সহ নানারকমের আয়োজন করে।  আবার গ্রুপে লেখা বা পোস্টের উপর ভিত্তি করে পুরস্কৃতও করা হয়।

ঐরকম উৎসব আর আয়োজন অনলাইনের থাকা লিখিবার পড়িবার কোনও স্বনামধন্য ব্লগ কর্তৃপক্ষও করতে পারে না বা করেও না। এসব করে থাকে ফেসবুকে থাকা পেইজ বা গ্রুপ পরিচারকগণ। এসব করার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো, লাইক আর গ্রুপের কর্মকাণ্ড প্রচার কারা।

এছাডাও বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা তো এখন একরকম ফেসবুক নির্ভর হয়ে গেছে। রাষ্ট্রপ্রধানরা তাঁদের সুকৃতি নিয়ে ফেসবুকে তাঁদের নিজস্ব পেইজ বা গ্রুপের প্রচার করে। যাতে তাঁদের জনপ্রিয়তা আরও বাড়ে।

বর্তমানে ফেসবুকে সারাবিশ্বের বেশির ভাগ রাষ্টপ্রধানদেরও পেইজ বা গ্রুপ আছে। তবে এসব ভিআইপি ব্যক্তিদের নামে পেইজ বা গ্রুপ কতটা সত্যিকারের তা অনেকের কাছেই সন্দেহের।

তবু অনেকেই সত্যি সত্যি রাষ্টপ্রধানদের পেইজ মনে করে লাইক দিচ্ছে, মন্তব্যও দিচ্ছে। আর ভিআইপি ব্যক্তিরাও তাঁদের পেইজ বা গ্রুপে তাঁদের গুণগান যেমন প্রচার করছে, তেমন আবার তাদের ফলোয়ারদের দিকে খেয়ালও রাখছে।

খেয়াল রাখছে এই কারণে যে, যদি তাঁদের কোনও অপকর্ম আর অসৎকর্মের খবর ফেসবুকে ভাইরাল হয়ে যায়? তাই বর্তমানে রাষ্ট্রপ্রধানরা ফেসবুকের দিকে বেশি খেয়ালি। তবে এসব ভিআইপি ব্যক্তিদের পোস্টে অন্যদের করা মন্তব্যের কোনও রিপ্লাই করা হয় না।

ভিআইপিদের পেইজ বা গ্রুপে মেসেজ পাঠানোর সিস্টেম থাকলেও কারোর মেসেজের উত্তর দেওয়া হয় না বলেই মনে হয়। তাঁরা শুধু লাইকের দিকে আর বাজে মন্তব্যের দিকেই বেশি খেয়াল রাখে।

যদি কেউ ভুলবশত মনের ক্ষোভে কোনও বাজে মন্তব্য করে, তাহলে কয়েকদিনের মাথায়ই খবর হয়ে যায়। মামলা হয়, কারাদণ্ডে দণ্ডিতও হয়। তাই বর্তমানে রাষ্ট্রপ্রধান, মন্ত্রী, নেতা, নেত্রীদের নিয়ে ফেসবুকে কেউ বেশি মাথা ঘামায় না, কেউ স্বইচ্ছায় কোনও মন্তব্য করতে চায় না।

এবার আলোচনায় আসা যাক ফেসবুকে থাকা লাল লাইক, সবুজ লাইক, আঙুল মার্কা লাইক, ইমেজি লাইক আর ট্যাগ ও শেয়ায় অপশন নিয়ে।

ফেসবুক সৃষ্টিলগ্নে এতো হরেকরকমের লাইক ছিল না। যদিও শেয়ার অপশন ছিলো, তবুও অনেক ব্যবহারকারী ঠিকমতো শেয়ার অপশনটা ব্যাবহার করতে পারিনি। আবার বেশিরভাগ ব্যবহারকারী ট্যাগ করাও বুঝতো না। ছিল না মেসেঞ্জার, ফ্রি ফোন কল, ভিডিও কল, ভিডিও শেয়ারিং-এর ব্যবস্থাও। ছিলো শুধু নিজ টাইমলাইনে ছবি আর কয়েক লাইন লেখা সহ স্ট্যাটাস দেওয়ার সিস্টেম।

ফেসবুকের বয়স বাড়ার সাথে সাথে ব্যবহারকারীদের সুবিধার কথা মাথায় রেখে ফেসবুক কর্তৃক্ষ বর্তমানে অনেক শর্টকাট সুবিধা ফেসবুকে যুক্ত করে ফেলেছে। যা ছিলো কল্পনার বাইরে।

বর্তমানে শুধু লাইকের জন্য নিউজফিডে থাকে, খবর বিনোদন সহ দেশবিদেশে ঘটে যাওয়া নগদ খবর। আছে দেশের বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকার খবর। সেসব পত্রিকার পেইজ থেকে প্রতি মিনিটে মিনিটে খবর আপডেট করা হচ্ছে।

ফেসবুক ব্যবহারকারী নিউজফিডে তা দেখতে পারছে, পড়তেও পারছে। লাইক দিচ্ছে। মন্তব্যও করছে। শেয়ার করছে। কিন্তু কোনও মন্তব্যকারীর মন্তব্যের উত্তর দেওয়া হয় না। আগে ফেসবুকে পত্রপত্রিকার খবরাখবর ছিল না, যা বর্তমান সময়ে দেখা যায়। এটা বিশ্ববিখ্যাত সামাজিক যোগাযোগ সাইট ফেসবুকের একরকম সফলতাও বলা চলে।

আগেই বলেছি ফেসবুকে সর্বপ্রথমও ট্যাগ সিস্টেম ছিল। যা ব্যবহারকারী বুঝেশুঝে ট্যাগ করতো। এখনো ট্যাগ সিস্টেম ফেসবুকে আছে। ট্যাগ হলো, শিকল। নিজের করা পোস্ট অন্যের ঘাড়ে চাপানোই হলো ট্যাগের কাজ।

তাই আগে ফেসবুক ব্যবহারকারীরা সহসা কেউ কাউকে ট্যাগ করতো না। এখন একটা লাইকের আশায় একটি ছবি আপলোড করে তা ৪০ থেকে ৫০ জন বন্ধুকে ট্যাগ করে বসে থাকে। যা একধরণের যন্ত্রণা।

যন্ত্রণা হলো এই কারণে যে, এক বন্ধুর একটা বল্টু মার্কা ছবি ফেসবুকে আপলোড করে তা অন্যকে কেন ট্যাগ করা হবে? এটা তো একরকম অন্যায়। কিন্তু ন্যয় অন্যায়ের দিকে আর কেউ বিচার বিবেচনা না করে শুধু একটা লাইকের জন্যই; সিরিয়াল ৪০ থেকে ৫০ জনকে একই শিকলে বেঁধে ফেলে। এতে কেউ কেউ বিরক্ত হয়ে সময়সময় ট্যাগকরীকে অনোফ্রেন্ডও করছে।

একবার শোনা গিয়েছিল ফেসবুক কর্তৃপক্ষ আনলাইক সিস্টেম চালু করবে। কিন্তু না, তা আর হয়নি। শুধু আলোচনার মাঝেই তা থেকে গেল। যদি ফেসবুক ব্যাবহাকারীদের ভাগ্যক্রমে আনলাইক সিস্টেম চালু হয়, তাহলে বোঝা যাবে লাইক লোভী ব্যবহারকাীদের কেমন অবস্থাটাই না হয়।

অনেকের মতে ফেসবুকে আনলাইক সিস্টেম চালু করার খুবই দরকার ছিল। দরকার ছিল এই কারণে যে, বর্তমানে শুধু আমাদের দেশের ফেসবুকাররা হচ্ছে লাইক পাগল। ফেসবুকে একটা লাইকের জন্য নিজের প্রেমিকার বিকিনি ছবিও ফেসবুকে আপলোড করছে।

বর্তমানেও একটা লাইকের জন্য আরও কত যে অভিনব কায়দা কৌশল অবলম্বন করে থাকে, তা আর লিখে শেষ করা যায় না। যদি ফেসবুক কর্তৃপক্ষ আনলাইক সিস্টেম চালু করতো, তাহলে দেখা যেত কত ছবিতে কত লাইক, আর কত আনলাইক!

লাইক পাগল ফেসবুকারা এখন সেলফি মোবাইল ব্যবহার করে। যেমন–OPPO মোবাইল। যা কিনা ছবি আর সেলফির জন্য বিখ্যাত। সেলফি যে কী, তা আমি নিজেও আগে জানতাম না। এখন জানি সেলফি কী?

সেলফি হলো, নিজের মোবাইল ফোন দিয়ে নিজের ছবি নিজে তোলা। এর নাম হলো সেলফি। ফেসবুকেও চলছে সেলফি ছবির রমরমা পোস্ট। আর লাইকের জন্য ভিক্ষা আর ফরিয়াদ।

লাইক পাগল ফেসবুকাররা তাদের ছবি পোস্টে লিখে থাকে, “ভাইয়া একটা লাইক দিবা?”

কিছু লাইক পাগল মেয়ে ফেসবুকার আছে। ওরা নিজের ছবি আপলোড করে ছবির উপরে লিখে থাকে, “ভাইয়া আমার কোনও ভাই নেই! ফেসবুকের সকল বন্ধুরাই আমার ভাই। ভাইয়া আমাকে দেখতে কেমন লাগছে? যদি ভালো লাগে তো একখান লাইক দিতে ভুলবেন না!”

আবার দেখি লেখা থাকে, “কেউ এড়িয়ে যাবেন না!”

আরও লেখা দেখি, “একটা লাইক বা একটা কমেন্ট করুন! আজ আপনার ভাল কিছু একটা হবে।”

কেউ আবার সরাসরি সাক্ষাতে বলে ফেলে, “ছবি ছাড়ছি, লাইক দিয়েন ভাই!”

কেউ লাইকের জন্য ধর্মের বানীও পোস্ট করে থাকে।

এমন আরও শতরকমের অভিনব কায়দায় অনেক ফেসবুকারকে লাইক ভিক্ষা করতে দেখা যায়। সেসব লাইক ভিক্ষুক ফেসবুকে এখনো আছে। ওরা পোস্টে মন্তব্যের জন্য পোস্ট করে না। আর মন্তব্য যে কী, সেদিকে ওরা গুরুত্বও দেয় না।

কেউ পোস্টে মন্তব্য করলে, সেই মন্তব্যের রিপ্লাইও করে না। ওরা শুধু লাইকের জন্যই ফেসবুকে ছবির পর ছবি আপলোড করতেই থাকে, আর ট্যাগ করতে থাকে।

এখন কথা হলো, ফেসবুকে ওইসব লাইক পাগলদের কাছে একটা লাইকের মূল্য কত হতে পারে? আমরা মনে হয় ফেসবুকার লাইক পাগলদের কাছে একটা লাইক মানে, দিল্লিকালাড্ডু আর পোড়াবাড়ির চমচমের মতো।

লাইক পাগল ফেসবুকাররা মনে করে থাকে, ফেসবুক কর্তৃপক্ষ হয়তো কোনও একদিন ফেসবুক ব্যবহারকারীদের পোস্টের লাইক হিসেব করে মিলিয়ন বিলিয়ন ডলারে পুরস্কৃত করবে। আসলে তাদের ধারণা কি ঠিক? তা টিক হোক আর না হোক, তাতে কারোর কিছুই যায় আসে বলে মনে করি না।

তবে ফেসবুক লাইক পাগলদের পোস্টে লাইক/কমেন্টও অন্যসব ব্যবহারকারীদের দেখেশুনে করতে হবে। কারণ, কোনও বন্ধুর অপছন্দের পোস্টে যদি আমি লাইক করে ফেলি, তো সেই বন্ধু আমার পর খুব রাগ করতে পারে।

আর না বুঝে মন্তব্য তো করাই যাবে না। কারণ, সময়সময় একটা মন্তব্যে সাংঘাতিক বিপদ টেনে আনতে পারে। আবার ঝগড়াও হতে পারে। সময়সময় ঝগড়া বেঁধেও যায়। এসবকিছু মাথায় রেখে নিজেকে নিরাপদে রেখে লাইক পাগলদের পোস্ট বুঝেশুনে লাইক ও কমেন্ট করতে হবে। তা না হলে কিন্তু লাইকের মূল্যের পরিবর্তে নিজের খেসারতের অধিক মূল্য অবশ্যই দিতে হবে।

প্রিয় পাঠক, লেখা পড়ে যদি ভালো লাগে দয়াপূর্বক লাইক/কমেন্ট ও শেয়ার করে বাধিত করবেন।

নিতাই বাবু:
ব্লগ ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমক,
সোনেলা ব্লগ শব্দনীড় ব্লগ।
২৭/০৫/২০২৩ইং।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আমার শৈশবের বন্ধু— শীতলক্ষ্যা

একটি মাঠ; হাজারো প্রাণের স্মৃতি

মা নাই যার, সংসার অরণ্য তার