বুড়ো হলেই কি বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হয়?
বাংলাদেশের ৮বিভাগীয় শহরের অলি, গলি, পাড়া, মহল্লার বাসা বাড়িতে অনেক বুড়ো-বুড়ি আছে। তাদের মধ্যে কেউ-না-কেউ অনেক সুখে আছেন। কেউ কেউ আছেন খেয়ে-না-খেয়ে তাদের ছেলে-মেয়েদের সংসারে অতি কষ্টে। আবার অনেক বুড়ো-বুড়ি সংসারের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে ভিক্ষার ঝুলি কাঁধে নিয়ে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে। আবার কেউ গেছেন ছেলে অথবা চেলের বউ কর্তৃক বৃদ্ধাশ্রমে।
তো এটা সত্য যে, যাপিত জীবনে বুড়ো বয়সেই মানুষের যত ঝামেলা আর যত কষ্ট! এই কষ্ট কেউ দেখে, কেউ শুনে, কেউ নিজেই ভোগে। এই কষ্ট ভোগ করাটা কিন্তু একরকম কর্মেরই ফল! এ কেমন কর্মফল, সেটা যে ভোগে সে-ই ভালো বোঝে। তারপরও একটু চিন্তা করলে বোঝা যায় যে, নিজের মা-বাবাকে যদি কেউ কষ্ট দেয়, সেইরকম কষ্ট নিজেরও একদিন-না-একদিন ভোগ করতে হয়।
যেমন: ❝সারাজীবন চাকরি বাকরি করে ছেলে-পেলের জন্য। চুরি দারি, আর ঘুষ খেয়ে মেদ ভূরি বাড়ায়। বাড়ি করে। প্রতি কোরবানি ঈদে বড় সাইজের গরু কিনে কুরবানি দেয়। ঈদের মার্কেট করে, সিঙ্গাপুর, নাহয় থাইল্যান্ড গিয়ে। এই ছেলে পেলেদের সুখে দিকে চেয়ে কতো গরিব মানুষকে যে ঠকায়, তার কোনও ইয়াত্তা নেই। স্ত্রীর কথা শুনে নিজের মা বাবাকে নিজের সংসারে রাখে না। রেখে গ্রামের বাড়িতে, নাহয় টাকা দিয়ে কোনোএক নিকটাত্মীয়ের কাছে। মা বাবা মৃত্যু সংবাদ শুনে লোক দেখানো দুই ফোটা চোখের জল ফেলে মাত্র। কিন্তু মনে মনে আল্লার দরবারে শুকরিয়া আদায় করেছে শতবার।❞
এখন কথা হচ্ছে, জন্মদাতা পিতা আর গর্ভধারিণী মা তো ওপারে চলে গেলেন, তারপর তো তাদের মতো কষ্ট ভোগ নিজেই করতে হয়।
বুড়ো বয়সে কারোর সুখ, কারোর হয় যতো কষ্ট!তা কীভাবে কষ্ট ভোগ করতে হয়, তার একটা উদাহরণস্বরূপ গল্প এখানে↓↓↓
এক লোক চাকরি থেকে অবসর নিয়েছে, বেশকিছু দিন গত হলো। নিজ তহবিলে যা ছিল, আদরের নাতি নাতকুরের পেছনে খরচ করতে করতে সব শেষ!
এখন ছেলের কামাই-রোজগারের সংসার। যার কারণে সংসারের দায়িত্ব ছেলের বউয়ের কাছে। যাকে বলে সংসার পরিচালনাকারী।
ছেলে ব্যাংকার। ছেলের ঘরে এক ছেলে, এক মেয়ে। সুখী সংসার যাকে বলে। সুখী সংসারে দুখের কারণ হয়ে দাঁড়ায়, বুড়োটা। বুড়োটা এক বাড়তি ঝামেলার মতো।
কিন্তু যেই সংসারে বাড়তি ঝামেলা মুরুব্বি, সেই সংসার আর বাড়িটাও মুরুব্বির। মুরুব্বি রিটায়ার হবার কিছু দিন পরেই বুড়ি মারা যায়। বুড়ি মারা যাবার বছরখানেক পর মুরুব্বি গ্রামের বাড়ি বিক্রি করে শহরে চার শতাংশ জায়গায় কোনরকম একটা বাড়ি করেছে। বাড়িটা চারদিকে প্রাচীর ঘেরা। একতলা টিনসেড দুই রুম বিশিষ্ট দালান ঘর। সাথে বাথরুম, গোসলখানা, রান্নাঘরও আছে। তারপরও বুড়োর থাকার জায়গা হচ্ছে না। সমস্যা বেগতিক!
দিন যত যাচ্ছিল, ছেলের বউয়ের নেকামি দিন দিন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে লাগলো। কাজের ছেলে আবদুল বলতে কেউ নেই, আছে শুধু বুড়োই। ছেলে বউয়ের কাপড় চোপড়ও সময়তে ধুইয়ে দিতে হয়।
ছেলে বউ আবার এক নামী-দামী স্কুলের শিক্ষিকা। সংসারে আর সব কাজের মধ্যে বুড়োর বড় কাজ হলো, নাতি নাতিন দুটো কিন্ডারগার্টেন স্কুলে আনা নেয়া। সময় সময় হাল্কা পাতলা রান্নার কাজও করতে হয় বুড়োকে। যেমন: ডিম ভাজা, ডাল গরম করা, চা বানানো ইত্যাদি।
বুড়ো করেও। বুড়ো কোনও কাজে অমত করে না। ছেলে বউ যা বলে, বুড়ো তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে। বুড়ো নিজেও তো কোনোএক সময় নিজের বাবা মাকে এমন করেছিল। সেই করা এখন নিজে ভোগ করা।
সেটা বুড়োর বেশ মনে আছে। মনে পড়লেই বুড়ো একা একা কাঁদে। বুড়োর কান্না কেউ দেখতে পায় না। কান্না দেখলেও মহাবিপদ হবে। তাই বুড়ো কারোর সামনে চোখের জল ফেলে না। কারোর কাছে মনের দুঃখও প্রকাশ করতে পারে না। এ-ভাবেই কেটে যাচ্ছে বুড়োর দিন আর রাত।
অনেক সময় ঠাণ্ডা, জ্বর, সর্দি, কাশি হলে বুড়োর জন্য প্যারাসিটামল ট্যাবলেট কেনার টাকাও থাকে না ছেলের বউয়ের কাছে। বউ বলে, ঠাণ্ডা জ্বর এমনিতেই সেরে যায়। সামান্য সর্দি জ্বরে ট্যাবলেট সেবন করা ঠিক না। এই বলে বুড়োকে শান্তনা দেওয়া হয়।
এভাবে হাড়ভাঙা খাটুনিতে বুড়ো একসময় দুর্বল হয়ে পড়লো। এখন আর বুড়ো আগের মতো পরিশ্রম করতে পারে না। তাই সংসারের বড় ঝামেলার বোঝা এখন এই বুড়ো লোকটা। বুড়ো শারীরিকভাবে নিঃশক্তি হবার কারণে এখন আর নাতি নাতিন নিয়ে স্কুলেও যেতে পারে না। সে কারণে ছেলের বউয়ের আরও জ্বলা বেড়ে যায়!
বুড়োর এই অবস্থা দেখে ছেলের বউ বলে, “ওনাকে যে-কোনও বৃদ্ধাশ্রমে নিয়ে রাখো। ওনাকে দিয়ে তো আর সংসারের দুই পয়সার কাজ হচ্ছে না। তা ছাড়া ছেলে মেয়ে দুটো বড় হয়ে যাচ্ছে। ওদের জন্য আলাদা শোবার ঘর দরকার। তোমার বাবাকে যদি বলি বারান্দায় ঘুমান, তিনি মন খারাপ করে। তার চেয়ে বরং কোনও এক বৃদ্ধাশ্রমে নিয়ে রাখো। আজকাল অনেক বৃদ্ধাশ্রম তৈরি হয়ে আছে। বৃদ্ধাশ্রমে খাওয়া দাওয়াও ভালো দেয়। সাথে চিকিৎসাও দেয়। বাড়ি থেকে দুইটি পয়সাও খরচ করতে হবে না। বরঞ্চ ঘরে আরও টাকা আসবে।”
স্ত্রীর কথায় স্বামী অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে থেকে জিজ্ঞেস করে, “তা কীভাবে ঘরে টাকা আসবে?"
স্ত্রী বললো, “কতো বড়লোকেরা সাহায্য সহযোগিতা করে। জামা দেয়, ঔষধ দেয়, টাকা দেয়, পয়সা দেয়। সেগুলো কি তোমার বাবা একা একা হজম করতে পারবে? খাওয়া- দাওয়াতো সরকারি। উপরি যা পাবে সব তো আমাদেরই। তাই তাড়াতাড়ি করে একটা ব্যবস্থা করে ফেলো। নাহয় সামনে ওনাকে নিয়ে আরও বিপদ হবে।"
স্বামী তার স্ত্রীর কথামত বৃদ্ধাশ্রমের খোঁজ নিলেন। রাখার ব্যবস্থা করলেন। দিন তারিখ ঠিক করলেন। স্ত্রীকে জানিয়ে রাখলেন। স্ত্রী স্বামীর কাছে বৃদ্ধাশ্রমের কথা শুনে খুবই খুশি হলেন। এই বুঝি বাড়ি থেকে এক ঝামেলার অবসান হতে লাগলো।
তারিখমত সকালবেলা বুড়োকে বলছে, “তাড়াতাড়ি দুমুঠো খেয়ে জামা কাপড় পড়ে নিন। দশটার আগে সেখানে যেতে হবে। আরামে থাকবেন, খাবেন, ঘুমাবেন।”
এসব কথাগুলো নাতি নাতিন দুটো দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছে। তারপর নাতি ওর বাবাকে জিজ্ঞেস করলো, “ আচ্ছা বাবা, দাদুকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে?"
বাবা বললো, “তোমাদের দাদূর জন্য একটা ভালো জায়গা ঠিক করেছি। আজ থেকে উনি সেখানে থাকবে।” বাবার কথা শুনে ছেলে বললো, “তা কোথায় বাবা?"
ছেলের কথায় বাবা বিরক্ত হয়ে সোজাসুজি বলে ফেললো, “বৃদ্ধাশ্রমে।"
ছেলে আবার জিজ্ঞেস করলো, “আচ্ছা বাবা, মানুষ বুড়ো হয়ে গেলে কি বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হয়? তাহলে তো একদিন তোমাকে আর মাকেও বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হবে। তাই না বাবা?"
বাপ-ছেলের কথপোকথন মা সামনে দাঁড়িয়ে শুনছিলেন। কিন্তু কোনও প্রত্যুত্তর নেই। ছেলের কথায় বাবার মুখও বন্ধ হয়ে গেল। বুড়ো বারান্দায় বসে সকালের নাস্তা খাচ্ছিলেন। বুড়োর মনটা খারাপ। কিছুক্ষণ পরই এই স্বাদের সংসার ছেড়ে বুড়োকে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হবে, তাই।
নাতি বুড়ো দাদুর সামনে এসে বললো, “দাদা, তুমি বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে যেখানে থাকবে, সেই জায়গাটা আমার বাবার জন্য সুন্দর করে রেখে দিও। আমার বাবাও তো একদিন বুড়ো হবে। বুড়ো হলে তো সবাইকে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হয়। তাই আগে থেকে যদি রেডি করা থাকে তো দোষ কী দাদু? চলো দাদু, আমিও আজ তোমার সাথে যাবো। তোমার সাথে গিয়ে বৃদ্ধাশ্রমটা চিনে আসবো। বাবা বুড়ো হলে যাতে দৌড়াদৌড়ি করতে না হয়। চলো দাদু চলো। বৃদ্ধাশ্রম কাকে বলে চিনে আসবো। আমার বাবার পরে তো আমাকেও ওখানে যেতে হবে। চলো দাদা চলো।"
আদরের নাতির মুখে এসব শুনে বুড়ো মানুষটি নাতিকে ঝাপটে ধরে কেঁদে কেঁদে বললো, "না দাদু ভাই, তোমাকে আমার মতো বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হবে না। তুমি তোমার মা-বাবার মনে কষ্ট দিও না। তুমি যদি তোমার মা-বাবার সেবাযত্ন করো, তাহলে তোমার সন্তানাদিও তোমাকে সেবাযত্ন করবে। আর তুমি তোমার স্ত্রীর কথায় মা-বাবার মনে কষ্ট দাও, তাহলে সেই কষ্ট তোমার জন্যও রেডি হয়ে থাকবে।
একসময় আমি আমার স্ত্রী বাধ্য ছিলাম। স্ত্রীর কথা শুনে নিজের মা-বাবার মনে অনেক কষ্ট দিয়েছি। আজ তাদের সেই কষ্টের মালা নিজের গলায় ঝুলছে!" এই বলেই বুড়ো মানুষটি নাতিকে ধরে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো!
এসব দেখে আর শুনে বুড়ো মানুষটির ছেলে ও ছেলের বউ এসে হাতজোড় করে বুড়োর কাছে মাপ চেয়ে বললো, "বাবা, আপনাকে আর বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হবে না। আপনি বাড়িতেই থাকবেন।"
প্রিয় পাঠক লেখা পড়ে ভালো লাগলে দয়াপূর্বক লাইক/কমেন্ট ও শেয়ার করে বাধিত করবেন।
নিতাই বাবু:
ব্লগ ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম,
সোনেলা ব্লগ ও শব্দনীড় ব্লগ।
২২/০৫/২০২৩ইং।
জ্ঞানময় একটা পোস্ট!
উত্তরমুছুনঅসংখ্য ধন্যবাদ!
মুছুন