দেবতা গণেশের আসল মাথা আর হাতির দেহ কোথায়?


গণেশ পূজা ও “মঙ্গলঘট”: একটি প্রশ্নের উত্তর সন্ধানে

আমি একজন সনাতন ধর্মাবলম্বী। অর্থাৎ আমি হিন্দু। ছোটবেলা থেকেই দেখে আসছি, আমার মা-বাবা, ভাই-বোন, কাকা-কাকী, মামা-মামীসহ হিন্দু সমাজের সকলেই ধর্মীয় নিয়মনীতি মেনে বিভিন্ন দেব-দেবীর পূজার্চনা করে আসছেন। আমিও প্রতিবছর নিজ এলাকায় অনুষ্ঠিত প্রায় প্রতিটি পূজায় অংশগ্রহণ করে ভক্তিভরে পালন করি।

সবচেয়ে বেশি আনন্দ উপভোগ করি আমাদের হিন্দু ধর্মের সবচেয়ে জাঁকজমকপূর্ণ উৎসব দুর্গাপূজায়। আর প্রতিবছর পহেলা বৈশাখ, অর্থাৎ বাংলা নববর্ষের এই দিনে, দিনটি শুরু করি গণেশ পূজা করে।

এই দিনেই প্রতি বছর নিজেকে একটি প্রশ্ন করি—
“আচ্ছা, দেবতা গণেশের মাথা হাতির কেন? গণেশের আসল মাথা কোথায় গেল? আর হাতির দেহটাই-বা কোথায় গেল এবং কিভাবে পূজিত হচ্ছে?”

এই প্রশ্নের উত্তর আমি কখনোই সঠিকভাবে পাইনি, এমনকি কোনো পুরোহিতের কাছ থেকেও নয়। কিন্তু আমি থেমে থাকিনি। আমার জানার আগ্রহ বরাবরই প্রবল। সেই আগ্রহ থেকেই একদিন ঘাঁটতে শুরু করলাম শিবপুরাণ।
সেখান থেকেই পেলাম গণেশের মাথা বিচ্ছিন্ন হওয়া এবং তাঁর দেহে হাতির মাথা স্থাপন হওয়ার কাহিনী।

পরবর্তীতে আমি আমার স্বর্গীয় বড়দার কাছে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করি। বড়দা যা বললেন, তা হুবহু মিলে গেল আমার মনের প্রশ্নের সঙ্গে। কিভাবে মিললো—সেটা আমি এই লেখার মাঝামাঝি অংশে উল্লেখ করছি। তবে আগে চলুন দেখে নিই শিবপুরাণ অনুযায়ী গণেশের জন্ম ও মাথা পরিবর্তনের ঘটনা।
---
শিবপুরাণ অনুসারে গণেশের জন্ম ও মাথা পরিবর্তনের কাহিনী

একদিন দেবী পার্বতী কৈলাসে স্নানের প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তিনি তাঁর অনুচর নন্দীকে দরজায় পাহারায় বসিয়ে বলেন—“যতক্ষণ না আমি স্নান শেষ করছি, কেউ যেন ভেতরে প্রবেশ না করে।”
নন্দী পার্বতীর আদেশ পালন করলেও, শিব এসে উপস্থিত হলে বাধা দিতে পারেন না। কারণ তিনি তো শিবের ভক্ত।
এই ঘটনায় বিরক্ত পার্বতী নিজের দেহের ঘাম ও হলুদ মিশিয়ে এক বালকের মূর্তি গড়ে তাতে প্রাণ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর নাম দেন গণেশ। তিনি গণেশকে আদেশ দেন—“আমার স্নান শেষ না হওয়া পর্যন্ত কেউ যেন ভেতরে ঢুকতে না পারে।”

ঠিক সেই সময়, শিব এসে ভেতরে ঢুকতে চাইলে গণেশ বাধা দেয়। শিব রেগে গিয়ে ত্রিশূল নিক্ষেপ করে গণেশের মাথা কেটে ফেলেন। পার্বতী এসে ছেলের ছিন্নদেহ দেখে ক্রোধে প্রলয় ডাকার হুমকি দেন।
শান্ত করার জন্য শিব দেবতা ব্রহ্মার শরণাপন্ন হন। ব্রহ্মা বলেন—“উত্তরদিকে মাথা দিয়ে শুয়ে থাকা যেকোনো প্রাণীর মাথা এনে গণেশের দেহে সংযুক্ত করতে হবে।”
শিবের একজন সহচর উত্তরমুখী একটি হাতি খুঁজে পেয়ে তার মাথা কেটে আনেন। সেই মাথা যুক্ত করে গণেশকে পুনর্জীবিত করা হয়।
---
গণেশের আসল মাথা ও হাতির দেহ কোথায়?

পার্বতীর মন তখনও শান্ত হয়নি। তিনি প্রশ্ন করেন:

> “গণেশ তো বেঁচে উঠলো, কিন্তু তাঁর আসল মাথার কী হবে? নিরীহ সেই হাতির দেহেরই বা কী হবে?”

তখন ব্রহ্মা তিনটি বিধান দেন:

১. গণেশের হাতির মাথা দেখে কেউ যেন ঘৃণা না করে। বরং তিনি হবেন ‘গণপতি’। ২. সব দেবতার পূজার আগে গণেশ পূজিত হবেন। গণেশের আসল মাথাও পূজিত হবে। ৩. হাতির দেহটিও পূজিত হবে গণেশের সঙ্গেই।

এরপর গণেশের ছিন্নমস্তক ও হাতির দেহ একসাথে মাটিচাপা দিয়ে রাখা হয়। সেখান থেকে একটি নারিকেল গাছ জন্মায়। সেই গাছের নারিকেলই গণেশের আসল মাথা।
আর হাতির দেহ মিশে যায় পৃথিবীর মাটির সাথে। সেই মাটি দিয়েই তৈরি হয় পূজার ঘট। এভাবেই এই নারিকেল ও ঘট “মঙ্গলঘট” নামে পরিচিত হয়ে ওঠে।
---
মঙ্গলঘটের গঠন ও তাৎপর্য:

মঙ্গলঘট গঠিত হয়:

মাটির ঘট

তাতে জল

তার উপর আম্রপল্লব

তার উপর একটি নারিকেল

তার উপরে থাকে একটি বস্ত্র (সাধারণত লাল বা সাদা)

এই ঘটই গণেশের দেহ ও নারিকেল গণেশের আসল মাথা হিসেবে পূজিত হয়।
আর তাই, যে কোনো পূজা শুরুর আগে মঙ্গলঘট স্থাপন করে পূজা শুরু করা হয়। পহেলা বৈশাখেও তাই হিন্দুরা নতুন বছরের সূচনা করেন গণেশ পূজা ও মঙ্গলঘট স্থাপনের মাধ্যমে।
---
আরও একটি প্রচলিত কাহিনী:
আরও একটি গল্প প্রচলিত আছে। সেটি হলো শনিদেব ও গণেশকে নিয়ে।
শনিদেব, পার্বতীর ভাই, বলেন—“আমি ভাগিনাকে দেখলে তাঁর মাথা বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।”
পার্বতী অনুরোধ করলে শনিদেব গণেশকে দেখতে আসেন, আর দেখা মাত্রই গণেশের মাথা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।
এরপর একইভাবে উত্তরমুখী হাতির মাথা এনে সংযুক্ত করা হয়।
---
উপসংহার:
আমরা এখন বুঝতে পারছি যে, গণেশের আসল মাথা হলো নারিকেল, আর হাতির দেহ হলো মাটি দিয়ে তৈরি ঘট। এদের নিয়েই মঙ্গলঘট, যা হিন্দুধর্মে পূজার সূচনাতে অপরিহার্য।

এই রহস্য অনেকের কাছেই অজানা। তবে শাস্ত্র ও লোকবিশ্বাসের ভিত্তিতে এটাই সত্য যে, গণেশ পূজার মধ্যে দিয়েই আমাদের নববর্ষ শুরু হয়, আর মঙ্গলঘটের মধ্যে দিয়েই পূজার শুভ সূচনা ঘটে।

---

নিতাই বাবু
নাগরিক সাংবাদিক
ব্লগ ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আমার শৈশবের বন্ধু— শীতলক্ষ্যা

একটি মাঠ; হাজারো প্রাণের স্মৃতি

মা নাই যার, সংসার অরণ্য তার