কামরূপ কামাখ্যা কি সত্যি যাদুর দেশ?
আমাদের দেশে ওঝা, বৈদ্য, কবিরাজ, ফকির, সাধু, সন্ন্যাসীর অভাব নেই। গ্রাম-গঞ্জ, হাট-বাজার, শহর-বন্দর, রাস্তাঘাট, ফুটপাত—সবখানেই তাদের আনাগোনা দেখা যায়। তারা প্রায়শই “কামরূপ কামাখ্যা”র দোহাই দিয়ে মানুষের হাতে তাবিজ-কবচ ধরিয়ে দিয়ে ইচ্ছেমতো টাকা-পয়সা হাতিয়ে নিচ্ছে। তাদের মুখে “কামরূপ কামাখ্যা”র নাম শুনে সাধারণ মানুষ একপ্রকার অন্ধবিশ্বাসে ডুবে থাকে।
এশিয়া মহাদেশের অধিকাংশ দেশেই এই প্রবণতা দেখা যায়। ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল ও মিয়ানমার—সব দেশেই মানুষ প্রচণ্ডভাবে ওঝা, ফকির, বৈদ্য, সাধু-সন্ন্যাসীদের ওপর নির্ভরশীল। নিজেদের ঘরের মানুষকে তারা বিশ্বাস করতে চায় না, অথচ এক ভণ্ড ফকিরের কথা চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করে। একদিকে যেমন দয়ালু, তেমনি কৃপণও—নিজের ভাই না খেয়ে থাকলেও তাকে একটাকা দেবে না, অথচ এক ভণ্ড ওঝাকে হাজার টাকা দান করে দেয়!
আসলে আমাদের অন্ধবিশ্বাসের রীতিনীতি এমনই। অনেকেই জানে না "কামরূপ" বা "কামাখ্যা" আসলে কী, কোথায় এবং এর তাৎপর্য কী। এই অজ্ঞানতার সুযোগ নিয়েই কথিত ওঝা, ফকির, বৈদ্যরা "কামরূপ কামাখ্যা" নামটি ব্যবহার করে ভয়ভীতির পরিবেশ তৈরি করে মানুষকে ঠকিয়ে যাচ্ছে।
তারা বলে, “কামরূপ কামাখ্যা এক যাদুর দেশ, সেখানে মানুষ গেলে আর ফিরে আসে না।” কেউ বলে, “আমি বহু তপস্যা করে সেখান থেকে ফিরে এসেছি, এখন যা খুশি তাই করতে পারি।” কেউ বলে, “সেখানে সিংহ ডাক দিলে পুরুষ মানুষের পুরুষত্ব হারিয়ে যায়।” কেউ আবার বলে, “নারীরা ঢাকঢোল বাজিয়ে পুরুষদের কান থেকে সেই ডাক আড়াল করে।”
আরও এক গল্প প্রচলিত—এক নদীর এপারে থাকে মানুষ, ওপারে নারী। মাঝিবিহীন ডিঙি নৌকায় ভেসে গেলে শুরু হয় নারীদের মধ্যে পুরুষকে ভাগ করে নেওয়ার কাহিনি! এসব অলীক রূপকথা সাধারণ মানুষের মনে এত গভীরভাবে ঢুকে গেছে যে তারা তা বিশ্বাস করেই।
অনেক ওঝা ফকির নিজেদের বর্ণনা করে এইভাবে—“আমি কামরূপ কামাখ্যা থেকে দুই যুগ পর ফিরে এসেছি”, “সেখানে এমন তন্ত্র শিখেছি, যা দিয়ে সবকিছু করতে পারি।” কেউ আবার কামরূপ রাজার ও কামাখ্যা দেবীর প্রেমের কাহিনি শোনায়—যেখানে এক পাহাড়কে অন্য পাহাড়ের সঙ্গে একত্রিত করার অসমাপ্ত চেষ্টার মধ্য দিয়ে এক রূপকথার গল্প রচিত হয়।
তবে আসল সত্যি হলো, “কামরূপ” হলো ভারতের আসাম রাজ্যের একটি জেলার নাম এবং “কামাখ্যা” হলো সেখানকার বিখ্যাত এক হিন্দু শক্তিপীঠ মন্দির। কামাখ্যা মন্দিরে মা কামাখ্যা দেবীর যোনী প্রতীক পূজিত হয়। “কামরূপ কামাখ্যা” শব্দদ্বয় মূলত দুটি আলাদা স্থাননাম, কিন্তু লোকমুখে তা একত্রে উচ্চারিত হয়ে রূপকথায় রূপ নিয়েছে।
আমার বড়দিদির বাড়ি ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার বীরপাড়ায়। ১৯৯১ সালের মাঝামাঝি আমি সেখানে গিয়েছিলাম। তখন কামাখ্যা মন্দিরের নানা গল্প শুনেছি। অর্থ ও সময়ের অভাবে মন্দিরে যাওয়া সম্ভব হয়নি। সেখানকার মানুষের মুখে শুনেছি, কিছু ভণ্ড উলঙ্গ সাধুদের আস্তানা আছে মন্দির এলাকায়, যারা গাঁজাসহ বিভিন্ন মাদক সেবন করে তন্ত্রমন্ত্রের ধ্বনি তোলে। ভক্তরা তাদের চরণে লুটিয়ে পড়ে পুণ্যের আশায়, যেমনটা আমাদের দেশেও অনেক মাজারে দেখা যায়।
তবে বাস্তবে কোনো অলৌকিকতা চোখে পড়েনি। “কামরূপ কামাখ্যা” আদৌ কোনো যাদুর দেশ নয়। এটি এক ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় তীর্থস্থান, যার চারপাশে কেবল কিছু লোককথা ও অন্ধবিশ্বাসের আবরণে আবদ্ধ কল্পনা কাজ করে।
---
নিতাই বাবু
২৯ এপ্রিল, ২০২৩
(ছবি: ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত)
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
nitaibabunitaibabu@gmail.com