বই কেনার টাকা দিয়ে দি রেইন ছায়াছবি দেখা


একসময়ের অর্ধ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত “দি রেইন”

একদিন স্কুলে ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের ক্লাস চলছিল। তখন আমার কাছে ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের বই ছিল না। টিফিন টাইমে আমি এক ক্লাসমেটের কাছ থেকে বইটা চেয়ে নিয়ে ক্লাসে বসে বসে মুখস্থ করছিলাম। টিফিনের পরেই ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের ক্লাস। আমি ক্লাসরুমে বসে পড়তে পড়তেই টিফিন শেষ হয়ে গেল। সবাই ক্লাসে ঢুকল, স্যারও এলেন। স্যার একে একে সবাইকে প্রশ্ন করতে লাগলেন। যাকে প্রশ্ন করছেন, সে দাঁড়িয়ে পড়া বলছে। এবার স্যার আমার দিকে আঙুল তুলে দাঁড়াতে বললেন। আমি দাঁড়ালাম। প্রশ্ন করলেন, আমি উত্তর দিতে পারলাম না। পড়া না পারায় স্যারের হাতে কয়েকটি বেতের বাড়ি খেলাম।

সেদিন বাসায় এসে মায়ের কাছে কাঁদতে কাঁদতে বললাম—
“মা, আমি আর স্কুলে পড়ব না।”
মা বললেন—
“কেন?”
আমি বললাম—
“আমার ইংরেজি দ্বিতীয় পত্রের বই নেই! আজ স্যারের হাতে মার খেয়েছি। দেখুন!”
মা দেখলেন আমার পিঠে ফুলে লাল দাগ। তেল-জল মিশিয়ে মাখিয়ে দিলেন।

রাতে বাবা বাসায় ফিরলে মা সব কথা খুলে বললেন।
বাবা বললেন—
“বইয়ের দাম কত?”
আমি বললাম—
“২০ টাকার মতো।”
বাবার কাছে তখন মাত্র ১৫ টাকা ছিল। তিনি সেই টাকা মায়ের হাতে দিলেন, আর বললেন—
“এই দিয়ে ও যেন বইটা কিনে নেয়।”
মা আমাকে সেই টাকা দিয়ে বললেন—
“কালই নারায়ণগঞ্জ থেকে বই কিনে আনবি।”
আমি বললাম—
“বইয়ের দাম তো ২০ টাকা।”
মা তখন আরও ৫ টাকা দিয়ে দিলেন। আমার জমানো ছিল আরও ৫ টাকা। সব মিলিয়ে ২৫ টাকা—আমি মহাখুশি!

পরদিন ছিল শুক্রবার। তখনকার দিনে শুক্রবারে নারায়ণগঞ্জে সব দোকান বন্ধ থাকে, সেটা আমার খেয়াল ছিল না। দুপুরে সামান্য খেয়ে স্কুলের জামা-প্যান্ট পরে শীতলক্ষ্যা নদী পার হয়ে হাঁটতে হাঁটতে নারায়ণগঞ্জ গেলাম বই কিনতে। কালীরবাজার, ডিআইটি মার্কেট, টানবাজার—সব ঘুরলাম, কিন্তু কোনো বইয়ের দোকান খোলা পেলাম না। হতাশ হয়ে বাসায় ফিরতে যাবো, তখনই চোখে পড়ল আশা সিনেমা হল।

সামনে বিশাল ভিড়, হৈচৈ, আর বিশাল বিলবোর্ডে লেখা—
“দি রেইন” – অর্ধ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ছায়াছবি। অভিনয়ে ওয়াসিম ও অলিভিয়া।

হঠাৎ মনে হলো, একবার দেখে যাই! ব্ল্যাকে টিকিট পাওয়া যাচ্ছে—সেকেন্ড ক্লাস ১০ টাকা। নিজেকে সামলাতে পারলাম না। টিকিট কিনে ফেললাম। হলের ভেতরে ঢুকে সিটে বসে পড়লাম। সন্ধ্যা ৬টা থেকে রাত ৯টা—“দি রেইন” দেখলাম মনোযোগ দিয়ে। সিনেমা শেষে বের হয়ে এক টাকার পরোটা-ভাজি খেলাম।

রাত তখন প্রায় সাড়ে ৯টা। ভেবেছিলাম পায়ে হেঁটে ফিরব, কিন্তু এত রাতে সম্ভব না। তাই রিকশায় চড়তে গেলাম। কালী বাজার থেকে চিত্তরঞ্জন কটন মিল গুদারা ঘাট পর্যন্ত রিকশাভাড়া ২ টাকা। দুইজন হলে ৪ টাকা। কিন্তু আর একজন যাত্রী কিছুতেই পাওয়া যাচ্ছিল না। প্রায় আধঘণ্টা বসে থেকে শেষে আমি নিজেই অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে একাই রিকশা নিয়ে চলে গেলাম গুদারাঘাট।

কিন্তু বিপত্তি বাঁধল সেখানে! এত রাতে খেয়া নৌকা ছিল না। মাঝিদের ব্যক্তিগত ছইয়ানৌকা ছাড়া আর কিছু ছিল না। অনেক অনুরোধ করে, দু’টাকা দিয়ে মাঝিকে রাজি করিয়ে নদী পার হয়ে বাসায় ফিরলাম। রাত তখন প্রায় ১১টা।

বাসার সামনে পৌঁছাতেই শুনি মা কাঁদছেন, আর বাবা ও বড়দা চিৎকার করছেন। আমি চুপিচুপি ঢুকতেই বড়দা আমাকে ধরে ফেলল। আশেপাশের মানুষও জড়ো হয়ে গেল। বাবা বললেন—
“মারবি না, আগে জিজ্ঞেস কর কোথায় ছিল।”
বড়দা জিজ্ঞেস করলেন—
“বই কই?”
আমি বললাম—
“আজ তো শুক্রবার, সব দোকান বন্ধ ছিল।”
বড়দা বললেন—
“তাহলে টাকা কই?”
ভয়ে বললাম—
“হারিয়ে ফেলেছি।”

এই কথা বলতেই বাবার বন্ধু গৌরাঙ্গ কাকা এসে আমাকে চড়থাপ্পড় মারতে লাগলেন। কেউ আমাকে থামাতে এল না। মা ও দিদিরাও সেদিন যেন কঠিন হয়ে গিয়েছিল। গৌরাঙ্গ কাকা আমাকে কাঁঠাল গাছের সঙ্গে দুই হাত পেছনে দিয়ে বেঁধে রাখলেন ‘সত্যি বের করার’ জন্য।

আমি কিছুতেই স্বীকার করলাম না। বলেই যাচ্ছি—
“টাকা পকেট থেকে পড়ে গেছে।”
রাত দুইটা পর্যন্ত গাছের সঙ্গে বাঁধা ছিলাম। মা কান্নাকাটি করে সবার কাছে অনুরোধ করে আমাকে ছাড়িয়ে আনলেন।

আমি তখন কাঁদতে কাঁদতে বললাম—
“আমার বাবার টাকা হারালে কাকার কী! উনি আমাকে মারলেন কেন?”
মা বললেন—
“চুপ কর! এই কাকাই তো একসময় তোর প্রাণ বাঁচিয়েছিল, যখন তোর গুটিবসন্ত হয়েছিল। আমাদের নিজের ঘরে থাকতে দিয়েছিল। আজ একটু মারলে কি হয়েছে? চল ভাত খেয়ে নে।”

কিন্তু সেদিন আমি কিছুই খেলাম না। সোজা শুয়ে পড়লাম।

পরদিন সকালে স্কুলে গেলাম। সহপাঠীরা হাসাহাসি করছিল—না জানি কে খবর দিয়েছে সিনেমা দেখার কথা। অবশেষে বিষয়টি পৌঁছে গেল বাংলা স্যারের কানে।
স্যার ক্লাস শেষে আমাকে নিজের রুমে ডেকে নিয়ে বললেন—
“সিনেমা দেখেছিস?”
আমি চুপ।
স্যার বললেন—
“এখন পড়াশোনার সময়। যদি লেখাপড়া শিখিস, একদিন তুই নিজেই একটা সিনেমাহল বানাতে পারবি। এখন মন দে পড়াশোনায়। সিনেমা তো অনেক দেখবি। একদিন তুই নিজেই সিনেমা বানাবি।”

স্যারের কথাগুলো মাথায় গেঁথে গেল। তারপর থেকে স্কুলে যতদিন পড়েছি, সিনেমাহলের পাশ দিয়েও যাইনি।

আর এখন? এখন ছোট ছোট স্কুলপড়ুয়া ছেলে-মেয়ের হাতে অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল। ওরা ক্লাসে বসেই মোবাইল টিপে।
আমাদের সময় এমন ছিল না।
---
🔸 লেখা: নিতাই বাবু
🔹 স্মৃতি ও শিক্ষা মিশ্রিত একটি সময়ের গল্প

ছবি: নেট থেকে সংরক্ষিত।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আমার শৈশবের বন্ধু— শীতলক্ষ্যা

একটি মাঠ; হাজারো প্রাণের স্মৃতি

মা নাই যার, সংসার অরণ্য তার