হিন্দু বিয়েতে সাত পাক ঘোরার মাহাত্ম্য
বিবাহের মূল মন্ত্র যা স্বামী-স্ত্রীরা প্রতিজ্ঞা করে থাকে:
“যদেতৎ হৃদয়ং তব তদস্তু হৃদয়ং মম।
যদিদং হৃদয়ং মম, তদস্তু হৃদয়ং তব।।”
— অর্থাৎ: তোমার এই হৃদয় আমার হোক, আমার এই হৃদয় তোমার হোক।
---
সাত পাক ঘোরার মাহাত্ম্য:
হিন্দু বিয়েতে সাত পাক ঘোরার সময়ে অনেক মন্ত্র পড়া হয়। বর-কনে পুরোহিত মহাশয়ের বলে দেওয়া মন্ত্র অনেক সময়েই না বুঝেই বলতে থাকেন। কিন্তু প্রতিটি মন্ত্রের একটি করে অর্থ রয়েছে, যা বিয়ের পরের জীবনের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে দেরি না করে জেনে নেওয়া যাক সাত পাকের মাহাত্ম্য!
---
প্রথম প্রতিশ্রুতি:
পবিত্র অগ্নির সামনে দাঁড়িয়ে বর কনেকে কথা দেন যে, বিয়ের দিন থেকে কনের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব তাঁর। অগ্নি এবং অন্যান্য দেবদেবীর আশীর্বাদে যাতে কোনওদিনই নবদম্পতির অন্ন-বস্ত্রের অভাব না হয়, সেই দায়িত্ব বর নেন। উত্তরে কনে প্রতিজ্ঞা করেন যে, সংসারের সুখের জন্য খুঁটিনাটি বিষয়ও তিনি নজরে রাখবেন। অর্থাৎ প্রথমে বর তাঁর স্ত্রী ও ভবিষ্যতের সন্তানদের যত্ন নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। বিনিময়ে কনেও প্রতিশ্রুতি দেন যে, তিনি তাঁর স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির পরিবারের যত্ন নেবেন।
---
দ্বিতীয় প্রতিশ্রুতি:
সাত পাকের দ্বিতীয় পাক ঘোরার সময়ে বর-কনে একে অপরকে প্রতিজ্ঞা করেন যে, তাঁরা জীবনের সব ওঠাপড়ায় একে অপরের সঙ্গে থাকবেন। বর কনেকে বলেন, যদি কখনও কোনও বিপদ আসে, তাহলে তিনি তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের রক্ষা করবেন। আবার কনে প্রতিশ্রুতি দেন যে, সব সময় তিনি তাঁর স্বামীকে সাহস ও শক্তি জোগাবেন। অর্থাৎ এবার বর প্রতিশ্রুতি দেন যে, তিনি স্ত্রীর সমস্ত বিপদ থেকে তাঁকে রক্ষা করবেন, এবং কনেও বলেন যে, তিনি স্বামীর দুঃখে পাশে থাকবেন।
---
তৃতীয় প্রতিশ্রুতি:
তৃতীয় পাকে বর এবং কনে একে অপরের পার্থিব সুখের প্রতি নজর দেবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেন। একই সঙ্গে আধ্যাত্মিক পথেও তাঁরা একসঙ্গে হাঁটবেন বলে অঙ্গীকার করেন। অর্থাৎ বর প্রতিশ্রুতি দেন যে, তিনি রোজগার করে পরিবারকে সুখে রাখবেন। একই প্রতিশ্রুতি এবার কনেও করেন।
---
চতুর্থ প্রতিশ্রুতি:
সাত পাকের চতুর্থ পাক ঘোরার সময়ে বর কনেকে বলেন যে, তিনি সর্বতোভাবে স্ত্রীর সম্মান রক্ষা করবেন। কনে প্রতিশ্রুতি দেন যে, সারাজীবন তিনি স্বামীকে ভালোবাসবেন এবং অন্য কোনও পুরুষের প্রতি আকৃষ্ট হবেন না। অর্থাৎ বর স্ত্রীর মতামত ও দায়িত্বকে সম্মান করার প্রতিশ্রুতি দেন, আর স্ত্রীও প্রতিজ্ঞা করেন যে, তিনি সেই দায়িত্ব পালন করবেন নিষ্ঠাভরে।
---
পঞ্চম প্রতিশ্রুতি:
একে অপরকে সব সময় ভালোবাসা ও সম্মান করার প্রতিজ্ঞা করা হয় পঞ্চম পাকটিতে। বর-কনে একসঙ্গে দেবতাদের কাছে প্রার্থনা করেন যাতে তাঁদের সংসার আনন্দ ও সমৃদ্ধিতে ভরে ওঠে এবং তাঁদের সন্তানরা সুস্থ থাকে। বর প্রতিশ্রুতি দেন যে, তিনি স্ত্রীর সঙ্গে বন্ধুর মতো সব বিষয়ে আলোচনা করবেন। কনেও প্রতিশ্রুতি দেন যে, তিনি তাঁর স্বামীকে সর্বদা সমর্থন দেবেন।
---
ষষ্ঠ প্রতিশ্রুতি:
ষষ্ঠ পাকের সময় বর ও কনে একে অপরের প্রতি সারা জীবন সত্য থাকার প্রতিজ্ঞা করেন। স্বামী স্ত্রীর প্রতি ও স্ত্রী স্বামীর প্রতি বিশ্বস্ত থাকার অঙ্গীকার করেন।
---
সপ্তম প্রতিশ্রুতি:
সাত পাকের শেষ পাকে বর বলেন, “এখন থেকে আমরা স্বামী-স্ত্রী হলাম, এখন থেকে আমরা এক।” কনেও তাতে সম্মতি জানান। অর্থাৎ স্বামী শুধুমাত্র জীবনসঙ্গী নয়, বন্ধু হিসেবেও স্ত্রীর পাশে থাকবেন। স্ত্রীও স্বামীর সঙ্গে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত থাকার প্রতিশ্রুতি দেন।
এই প্রতিশ্রুতিগুলো পরস্পরের প্রতি বহন করতে হয় বলেই হিন্দু বিয়ের শাস্ত্রীয় নাম হলো ‘বিবাহ’, অর্থাৎ বিশেষভাবে বহন করা। তাই হিন্দু বিয়ে মানেই আজীবনের সুরক্ষা ও অবিচ্ছেদ্য সুখ-শান্তির প্রতিশ্রুতি।
---
– নিতাই বাবু
নাগরিক সাংবাদিক, ব্লগ ডট বিডিনিউজটোয়েন্টিফোর ডটকম
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন
nitaibabunitaibabu@gmail.com